ডেলে ব্লিন্ড কিছুটা অগোছালো ক্রস বাড়িয়েছিল স্পেনের বক্সের দিকে। যার উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছিল বলটা তিনি তখনো খানিকটা দূরে। তবে যা হবার হবে এমন ভেবেই বক্সের কাছাকাছি এসে দিলেন এক লাফ। এরপর যা হলো সেটা অবিশ্বাস্য, ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মত।
স্প্যানিশ গোলরক্ষক ইকার ক্যাসিয়াসের তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। উড়ন্ত হেডারে বল আশ্রয় নিলো জালে। ২০১৪ বিশ্বকাপ যারা দেখেছেন তারা সবাই আজন্ম মনে রাখবেন সেই মুহূর্ত ৷ আর সেই উড়ন্ত মানব ডাচ কিংবদন্তি রবিন ভ্যান পার্সি।
৬ আগস্ট, ১৯৮৪; বব পার্সি এবং হোস র্যাস দম্পতি বসবাস শুরু করেন নেদারল্যান্ডসের নির্মল এক শহরে। এই নির্মল রটারডামেই পার্সি দম্পতির সংসারে তৃতীয় সন্তান হিসেবে আসেন রবিন ভ্যান পার্সি। মা হোস র্যাস ছিলেন চিত্রশিল্পী, বাবা ছিলেন ভাস্কর। জিনগতভাবেই রবিনের রক্তে মিশে আছে শিল্প।
তবে তাঁর শিল্পীমন খুঁজে নেয়নি মাটির কারুকাজ কিংবা ছবির খাতা – বরং ফুটবলের শিল্পী হয়ে ওঠার পিছনের মনোযোগ দেন রবিন। স্কুলে পড়ার চেয়ে খেলার দিকেই নজর ছিল তাঁর; ইয়োহান ক্রুইফকে আদর্শ মেনেই শুরু হয়েছিল ফন পার্সির পথচলা। এরপর মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তাঁকে দলে ভিড়িয়েছিল স্থানীয় ক্লাব এক্সেলসিয়র। নিজের সহজাত প্রতিভা কাজে লাগিয়ে ক্লাবে পার্সি হয়ে উঠেছিলেন সেরা।
তাকে গড়ে তোলার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল এক্সেলসিয়র। সেখানে প্রায় এক যুগ শেষে যখন এক্সেলসিয়র থেকে ফেইনুর্দে দলবদল করলেন পার্সি, তত দিনে তিনি ক্লাবের সেরা তরুণ।
এই ক্লাবের হয়েই তিনি অনূর্ধ্ব-১৯ ও অনূর্ধ্ব-২১ দলে খেলা শুরু করেন। শেষমেশ মূল দলে ইনজুরি হানা দেয়ায় ডাক হয় রবিন ফন পার্সিকে। অসামান্য ফুটবল কৃতিত্বের কারণে ২০০১-২০০২ শ্রেষ্ঠ তরুণ খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০০২ সালে পিঠের ইনজুরির কারণে মূল দলে জায়গা হারান রবিন। তবে পরের মৌসুমে লিগের ২৮ ম্যাচে ৮ গোল করে তিনি নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দেন।
অবশ্য কোচ বার্ট ফন মারউইক্সের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় সাইড বেঞ্চে বন্দী হয়ে পড়েন রবিন ফন পার্সি। শেষ পর্যন্ত ২০০৪ সালে আর্সেন ওয়েঙ্গার তাকে সেই বন্দী দশা থেকে মুক্তি দেন। সে বছরের ৮ মে এফএ কাপে অভিষেক হয় রবিনের। প্রথম দিকে দলে একজন উইঙ্গার হিসাবে খেললেও পরবর্তীকালে ডেনিস বার্গক্যাম্পের অবসর গ্রহণ করার পর স্ট্রাইকার হিসাবে খেলা শুরু করেন।
যখন যেভাবে দলে সুযোগ পেয়েছিলেন সেভাবেই ফন পার্সি তাঁর সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে দিয়েছিলেন। এসময় নিজের ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারে যোগ করেন অসংখ্য গোল।
২০১২ সালে আর্সেনাল ছেড়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেন রবিন ফন পার্সি। এর আগে গানারদের হয়ে মোট ২৭৮ ম্যাচ খেলে ১৩২ গোল এবং ৫৮টি অ্যাসিস্ট করেন তিনি।
রেড ডেভিলদের ২০তম লিগ শিরোপা জেতানোর প্রতিজ্ঞাস্বরূপ নিজের জন্য ২০ নম্বর জার্সি বেছে নেন এই ডাচ তারকা। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডেই নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরতে সক্ষম হন তিনি। সেইসাথে পূরণ করেন প্রতিজ্ঞা। ২০১২/১৩ মৌসুমে ম্যান ইউনাইটেড প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জিতে নেয়; আর ভ্যান পার্সি নির্বাচিত হন ক্লাবের মৌসুম সেরা ফুটবলার। একই বছর লিগে গোল্ডেন বুটও জিতেছিলেন তিনি।
সব মিলিয়ে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইংলিশ ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন রবিন ভ্যান পার্সি। ১০৫ ম্যাচে ৫৮ গোল আর ২১টি অ্যাসিস্ট এসেছিল তাঁর পা থেকে। ইংল্যান্ড থেকে চলে আসার পর দুই বছর তুরস্কে কাটিয়েছেন তিনি, তুরস্ক ঘুরে আবারও ফিরে আসেন ফেইনুর্দে – যেখানে পার্সির পথ চলা শুরু হয়েছিল। এক বছর এই ক্লাবে খেলা অবস্থায় নিজের বুটজোড়া তুলে রাখেন তিনি।
জাতীয় দলের হয়ে রবিন ভ্যান পার্সি নিজে হয়তো সফল তবে দলীয় অর্জনের হিসেবে বড্ড শূন্য নেদারল্যান্ডস। ডাচদের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা ফুটবলার হলেও জিততে পারেননি বলার মত কোন ট্রফি। তারপরও ভ্যান পার্সি চেষ্টা করেছেন, আফ্রিকার মাটিতে সেবার ইকার ক্যাসিয়াস বাঁধা হয়ে না দাঁড়ালে হয়তো ২০১০ সালের বিশ্বকাপ তাঁর হাতেই উঠতো।
তরুণ বয়সেই ক্যারিয়ারে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করতে শুরু করেছিলেন রবিন ভ্যান ফার্সি। লম্বা এক ক্যারিয়ারে পারফর্ম করার সেই ধারায় কোনো ছেদ পড়েনি। ড্রিবলিং,দুর্দান্ত পজিশনিং সেন্স, বলের উপর নিয়ন্ত্রণ – সবকিছু দিয়েই দর্শকদের মোহিত করতে ভুল হয়নি তাঁর।
রবিন ফন পার্সির ক্যারিয়ারের স্মরণীয় মুহূর্ত থেকে যেকোন একটা বের করা বেশ কঠিনই হবে। তাঁর সেরা স্মৃতিগুলো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে নেদারল্যান্ডস আর ইংল্যান্ডের অনেকটা জুড়ে।
ফেইনুর্দে পার্সির খেলা পাঁচ ক্লাবের জার্সি এক করে অসাধারণ ‘ম্যাশ-আপ’ জার্সি তৈরি করেছিল। কিন্তু জার্সি উপহার দিলেও জয় উপহার দিতে পারেনি তারা। তাইতো বিদায়ী বেলায় পরাজয়কে সঙ্গী করেই বুটজোড়া খুলে রেখেছেন রবিন ভ্যান পার্সি।
অবশ্য ডাচ কিংবদন্তির পুরোটা ক্যারিয়ারেই আছে বিষাদ। কখনো উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে পারেননি, হাত ছোঁয়া দূরত্বে থেকেও ধরতে পারেননি সোনালি ট্রফি। তবু বিষাদে ভরা পার্সির গল্প মানুষ মনে রাখবে; মনে রাখবে ফ্লায়িং ডাচম্যানের কাব্যিকতা।