জীবনের রোল মডেল

ক্রিকেট নিয়ে লেখা এখন বেশ চাপের। একটা জেনারেশন গ্যাপ এখানে কাজ করছে। রাহুল, সৌরভ, কুম্বলের সময়ের আমি ধোনি, বিরাট, রোহিতদেরকেও দেখেছি এবং এখন পান্ত, গিল, শ্রেয়াসদেরও দেখছি। স্বাভাবিকভাবেই নিজের কৈশোর বা যৌবনের স্পোর্টস আইডলদের নিয়ে মানুষের একটা রোমান্টিসিজম থাকে, একটা স্মৃতিমেদুরতা যা অনেক সময়েই বাস্তব বোধ – বুদ্ধিকে গুলিয়ে দেয়।

নিজের সময়ের কোনো ক্রিকেট তারকাকে নিয়ে লেখা মানেই তাই বায়াসড হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকেই এবং তাহলেই ‘হাঁটুর বয়েসিদের’ কাছে অপমানিত হবার সিঁদুরে মেঘ ও দেখা দেয়। কিন্তু আপনাকে নিয়ে লেখা অনেক নিরাপদ। এটা একদম নিশ্চিত যে আপনাকে নিয়ে ‘কাব্যি’ করলেও গালিগালাজ এর ভয় নেই। টেস্ট আর ওয়ানডে মিলিয়ে ৬৩৪ ম্যাচে ৩৪, ৩৪৭রান!

এর সঙ্গে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের পঁচিশ হাজার তিনশো ছিয়ানব্বই যোগ করলে ব্যাপারটা বড্ডই ভেবলে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলার মত হয়ে যায়। গলি ক্রিকেটে ও চব্বিশ বছর খেলাটা চাপের সেখানে একটা মানুষ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছে চব্বিশ বছর! স্ট্যাটস এ গুলি মারুন। শুধু মনে মনে বার কয়েক উচ্চারণ করুন – চব্বিশ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট – চব্বিশ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট – চব্বিশ বছর ধরে…।

দেখুন ক্রমাগত বলতে বলতে একটা ঘোরের মত চলে আসবে। এবং ওই ঘোর টার নামই শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। নিজেকে মাঝে মাঝে  খুব ভাগ্যবান মনে হয় যে আমি গাভাস্কারকেও দেখেছি ( খুব কম হলেও ) আবার আপনাকেও দেখেছি।

ছোটবেলায় জন ম্যাকেনরোর অন্ধ ভক্ত অবশ্য স্কুলে ‘বুলি’ হওয়ার খ্যাতি পেয়েছিলেন’। অভিধান দেখাচ্ছে ‘বুলি’ শব্দের বাংলা অর্থ হল – যিনি নিজের শারীরিক সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে শারীরিক ভাবে দুর্বলদেরকে আঘাত করেন বা ভয় দেখান বা নিজের ইচ্ছামত কাজ তাদেরকে দিয়ে করিয়ে নেন। অজিত টেন্ডুলকার নিজের ভাইয়ের গুন্ডামি আটকানোর জন্য একটা ছোট্ট অ্যাডজাস্টমেন্ট করেছিলেন।

তখন তাঁর দূরতম কল্পনাতেও এটা ছিল না যে তাঁর ওই ছোট্ট কাজটার জন্যই তাঁর ভাই উইজডেনের বিচারে ডনের পরেই সর্বকালের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান অথবা ভিভের পরেই সর্বকালের সেরা ওয়ানডে ব্যাটার ( তখনও অবশ্য ব্যাটসম্যানই বলা হত ) বিবেচিত হবেন। এবং অজিতের ছোট্ট অ্যাডজাস্টমেন্ট এর চরমতম ফল ছিল আপনার ভারতরত্ন পাওয়া। হ্যাঁ, ক্রিকেট খেলে ভারতরত্ন! কী ছিল সেই ছোট্ট অ্যাডজাস্টমেন্টটা?

অজিত শুধু গুন্ডামিটা কে ক্রিকেটের মাঠে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। সৎ ভাইবোনদের সম্পর্ক নিয়ে অনেক কিছু দেখেছি আমরা সিনেমা বা সিরিয়ালে। কিন্তু অজিত আর আপনার সমীকরণটা আলাদাই ছিল!

আপনাকে দেখলে , আপনার ক্রিকেট দেখলে, আপনার ক্যারিয়ার দেখলে শ্রদ্ধেয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কে ধার করতে হয় ( যদিও গৌতম ভট্টাচাৰ্য এই কাজটা আগেই করে বসে আছেন ) – শরীর , শরীর তোমার মন নাই কুসুমও একটু বদলে দিয়ে, ক্রিকেট ক্রিকেট শুধু ক্রিকেট তোমার আর কোনো জগৎ নেই শচীন!

ষোলো বছর বয়েসে ক্রিকেট শুরু করে একটা লোক যখন ক্রিকেট মাঠকে ‘আলবিদা’ করছে তখন তার কৈশোর আর যৌবন দুটোই পেরিয়ে গেছে। ব্যক্তিগত ভাল লাগা, মন্দ লাগা কে পাত্তা না দিয়ে ছোট ছোট খুশিগুলোকে বিসর্জন দিয়ে লোকটা যন্ত্রের মত ক্রিকেট খেলেছে।

হ্যাঁ, শচীন রমেশ টেন্ডুলকার কে আমার রোবট বলেই মনে হয়েছে বরাবরই। মাঠে নামো আর পারফর্ম করো। শুধুই অর্থের জন্য চব্বিশ বছর ধরে এটা করা যায় না! একটা তীব্ৰ পাগলামি প্রয়োজন এর জন্য। ক্রিকেটের জন্য পাগলামি।

আপনাকে নিয়ে অনেক লেখা আসবে অনেক, যেকোনো দিনেই। তাতে পরিসংখ্যান থাকবে, বিশ্লেষণ থাকবে, ক্রিকেট পান্ডিত্য থাকবে। আমার সে সব সাধ্য নেই। আর কেন জানি না আমার খালি মনে হয় আপনার ক্রিকেট জীবন, আপনার অ্যাচিভমেন্ট নিয়ে আর নতুন কী ই বা বলার বাকি আছে? কিন্তু তাই বলে আপনার জন্মদিনে কিচ্ছু লিখব না তাই বা কী করে হয়! তাই এলোমেলো কয়েকটা লাইন! মায়েস্ত্রোদেরকে কেই আর কবে কয়েকটা শব্দের মধ্যে ধরতে পেরেছে?

ভাল থাকবেন শচীন। ক্রিকেটেই থাকবেন। জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রের পেশাদারের জন্যই আপনার থেকেও ভাল রোল মডেল ? নাহ, কেউই নেই বোধহয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link