পুরনো সেই জোটের দুই হারানো বন্ধু

ওর মন পড়ে ফেলতে পারা মার্সেলোকে মিস করে খুব, ইতালি থেকে স্পেনে লেগে থাকে বন্ধুত্বের দাগ। মনের রঙ যে দাগ রেখে যায় তার উদাহরণ সারে সারে সাজানো আছে মাদ্রিদ ট্রফি ক্যাবিনেটে, সাজানো আছে কর্ণার ফ্ল্যাগ দিয়ে ছুটে আসা দুই বন্ধুর সেলিব্রেশন স্টাইলে - হারানো বন্ধুর খোঁজে মার্সেলো আর রন এখনো গোলের পর দৌড়ে যান কর্ণার ফ্ল্যাগের দিকে, ভালবাসার পিয়ানো বেজে ওঠে তুরিন থেকে মাদ্রিদে।

মাদ্রিদ প্রেসিডেন্ট ১৯ বছরের ছেলেটাকে ফ্লুমিনেজ থেকে নিয়ে এল মাদ্রিদ সাম্রাজ্যে। সকালে প্র‍্যাক্টিসে গিয়ে মনমরা হয়ে বসে আছে ছেলেটা। সান্টিয়াগো বার্নাব্যুতে তখন চাঁদের হাট। স্নাইডার-রবেন-রবিনহো-রাউল-ক্যানাভারোদের ভিড়ে ওর বন্ধু বলতে বছরখানেকের বড়ো র‍্যামোস আর হিগুয়েন।

কোচের শিডিউল মেনে তিনজন প্র‍্যাক্টিস করে, বাড়ি ফিরে যায়। মরশুমে বেশ কিছু ম্যাচে সুযোগ এল। মন্দ খেলল না। পরের মরশুমেও রইল দলে। কিন্তু ঝাঁকরা চুলের ব্রাজিলিয়ান কিছুতেই ফুটবলের সেই দিলদরিয়া পাস, সেই আনন্দে মেতে ড্রিবল করে যাওয়া, গোলের পর সেলিব্রেশন, সুর-তাল-লয়ে বাঁধা সাম্বার ঝলক পাচ্ছে না স্পেনের ফুটবল মক্কায়। ব্রাজিলের ফুটবলের সাথে যেন প্রাণের টান নেই, যেন বন্ধু ছাড়া মাঠে নামা, যেন কেউ নেই যাকে চোখ বুজে বলটা বাড়িয়ে দিয়ে শুরু করে দিতে পারে সেলিব্রেশনের প্রস্তুতি।

সারাবিশ্বে ঝড় তুলে মাদ্রিদে এল ম্যানচেস্টারের হার্টথ্রব, বিশ্বফুটবলের সেনসেশন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ডেভিড বেকহ্যাম পরবর্তী জমানায় এই প্রথম মাদ্রিদ জনতা উন্মাদ হয়ে গেল এক পর্তুগীজ তরুণের আগমনে। মাদ্রিদ কর্তা যখন বার্নাব্যুতে প্রেজেন্ট করছেন রোনালদোকে তখন যেন হাজার ওয়াটের আলো তার মুখে, লক্ষ লক্ষ মাদ্রিদ সমর্থক সবকিছু ভুলে বরণ করে নিচ্ছে তাদের যুবরাজকে।

এই অবস্থায় মাদ্রিদের দলীয় কোন্দল শুরু হল,গুমোট হল ড্রেসিংরূম। সকলের মধ্যে চলতে লাগল ইগোর লড়াই। ম্যানচেস্টার থেকে আসা তরুণ মাদ্রিদের ঘরের ছেলেদের লাইমলাইট কেড়ে নেবে? মানতে সমস্যা হল অনেকেরই।

প্রথমদিন রোনালদো প্র‍্যাকটিসে নেমেই যেন খুঁজে নিল তাঁর বন্ধুকে। ম্যাঞ্চেস্টারে যে ওয়েন রুনি আর রিও ফার্দিনান্দ তাঁকে আগলে রাখতেন সেই ভাবেই ঝাঁকরা চুলের মার্সেলোর চুলটা এলোমেলো করে দিয়ে হাসতে লাগলেন আদরের বড়দা।

মার্সেলোর কাছে ঐ ছোঁয়াটুকুই হয়ে রইল সাম্বার স্পর্শ – এলোমেলো ঝড় ওঠার আগে দুটো নিখাদ বন্ধুত্বের হাসি বার্ণাবিউতে ছড়াল রঙ। প্র‍্যাকটিসে শুরু হল জুতো বদলাবদলি। শুরু হল জলের বোতল লুকিয়ে রাখার দুষ্টুমি, শুরু হল বল নিয়ে দুজনের কায়দা দেখানোর খুনসুটি।

গুমোট মাদ্রিদ ড্রেসিংরুম খেলে গেল বসন্তের বাতাস। পর্তুগিজ ভাষা হল একটা অদ্ভুত আলোর সুতো। লাতিন আমেরিকার সব দেশ স্প্যানিশ ভাষা ব্যবহার করলেও ব্রাজিলের ভাষা পর্তুগীজ। লিসবনের রণ আর ব্রাজিলের মার্সেলোর প্র‍্যাক্টিসের পর শুরু হত আড্ডা।

কোচ দুদলে ভাগ করে প্র‍্যাকটিস ম্যাচ খেলালে আবদার হতো দুজনকে একই দলে রাখার। শুরু হল বুনোট, শুরু হল মার্সেলোর চোখ বুজে বড়দাকে খুঁজে নেওয়ার মহড়া, শুরু হল প্রত্যেকটা ঠিকানা লেখা পাস থেকে গোল করে সেলিব্রেশনে জাপটে ধরা অচেনা মাদ্রিদে তাঁর প্রথম বন্ধুকে।

তৃতীয় গোলটা হবার পরেই কিয়েভে শুরু হল সেলিব্রেশন। মেসি-পেপ-জাভিয়েস্তা-আলভেস জমানায় প্রায় ফুরিয়ে আসা মাদ্রিদের ছাই থেকে ফিনিক্সের মতো উঠে এসে চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাস পাল্টে দিল রিয়াল মাদ্রিদ; ২০১২ এর পর থেকেই একটু একটু করে ক্লাসিকোয় খেল দেখাতে শুরু করল মার্সেলো-রণ ম্যাজিক, প্র‍্যাক্টিসে দুই বন্ধুর খুনসুটিই মাঠে নেমে এল ডাইরেক্ট ফুটবলের নিখুঁত স্ক্রিপ্ট হয়ে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের হ্যাট্রিকে ফুল ফোটাল দুই বন্ধু, ক্লাসিকোর একচ্ছত্র মেসি প্রাধান্য কিংবা লা-লিগায় বার্সার ধারাবাহিকতা ধাক্কা খেল রণ-মার্সেলো দেওয়ালে।

ট্যাক্স জালিয়াতির দায়ে বেসামাল রণের পাশে দাঁড়ালেন মার্সেলো, মার্সেলোর পারিবারিক সমস্যায় বড় দাদার মতো এগিয়ে এলেন রোনাল্ডো৷ ব্রাজিলিয়ান-পর্তুগীজ রূপকথা লেখা হল টানা নয়টা মৌসুম ধরে বার্নাব্যুর সবুজ ঘাসে।

তুরিণের টিকিট ধরার আগে কাউকে কিচ্ছু জানতে না দেওয়া রোনালদো প্র‍্যাকটিস শেষে সবার অগোচরে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধুকে, ভেঙে পড়লেও মার্সেলো জানতেন রোনালদো এমন এক জাহাজ যা বন্দরের ছায়ায় নয় সমুদ্রের গভীরে লড়তে ভালোবাসে, ঘরছাড়া ঝড় রোনালদোকে মার্সেলো জানালেন- ‘Whatever decission you made,I will be there in your side…’

সেই ৯ মৌসুম আর ফিরে আসবে না। মাদ্রিদ জনতার কিশোর-রফি জুটি সুরের দাগ রেখে চলে গেছে অনেক দূরে। এরপরও প্র‍্যাকটিসে আসতেন মার্সেলো, সেদিনের অচেনা মাদ্রিদ শেষ বেলায় ছিল হাতের তালুর মতো চেনা, শুধু সেদিনের নি:সঙ্গতা লেগে ছিল শেষ দিন পর্যন্ত। তুরিণেও ক্রসগুলো মাথায় না এলে রাগ হয় বড়দার, গ্রাউন্ডার গুলো ডিফেন্স জঙ্গলে আটকে গেলে মাথাটা আগুন হয়ে যায়, মনে হয় যেন বড় একা সে।

ওর মন পড়ে ফেলতে পারা মার্সেলোকে মিস করে খুব, ইতালি থেকে স্পেনে লেগে থাকে বন্ধুত্বের দাগ। মনের রঙ যে দাগ রেখে যায় তার উদাহরণ সারে সারে সাজানো আছে মাদ্রিদ ট্রফি ক্যাবিনেটে, সাজানো আছে কর্ণার ফ্ল্যাগ দিয়ে ছুটে আসা দুই বন্ধুর সেলিব্রেশন স্টাইলে – হারানো বন্ধুর খোঁজে মার্সেলো আর রন এখনো গোলের পর দৌড়ে যান কর্ণার ফ্ল্যাগের দিকে, ভালবাসার পিয়ানো বেজে ওঠে তুরিন থেকে মাদ্রিদে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...