সর্বকালের সেরা ফুটবলাদের কথা আসলে তর্ক হতে পারে। কিন্তু ‘সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার’ এর প্রসঙ্গ আসলে তাঁকে বিতর্কিত-হীন ভাবে সবার সেরা বলা যায়। সর্বকালের সেরা নাম্বার নাইন রোনালদো, দ্য ফেনোমেনন। হয়তো ইনজুরি বাধ না সাধলে ‘সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার’ এর জায়গায় ‘সর্বকালের সেরা ফুটবলার’ ট্যাগটা বিতর্কিত-হীন ভাবে লেগে যেত।
কিংবদন্তি কোচ মার্সেলো লিপ্পি বলেছিলেন, ‘রোনালদো এতোটা ভয়ংকর ছিল, যে বেশিরভাগ কোচ তার বিরুদ্ধে খেলার সময় ডাবল ডিফেন্সিভ লাইন ধরে রেখে খেলত তবুও তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না।’
ভিসেন্তে ডেল বস্ক বলেন অন্য কথা, ‘রোনালদোর বিপক্ষে খেলার সময় তার বিরুদ্ধে পরিকল্পনা না করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করাই উত্তম। কারণ, রোনালদো চাইলে দুনিয়ার যে কোনো পরিকল্পনা বা মার্কিং ভাঙতে পারে।’
কিংবদন্তি ডিফেন্ডার মালদিনি তো কষ্টে বলেই দিয়েছিলেন ‘রোনালদোকে আটকানো অসম্ভব।’ আরেক কিংবদন্তি গোলরক্ষক অলিভার কান রোনালদোর জার্সির সাথে ছবি তুলে ক্যাপশন দিয়েছিলেন ‘আমার দুঃস্বপ্ন’।
কি ছিলেন রোনালদো? হোসে মরিনহো বলেন, ‘প্রতিভার আর ফুটবলের দক্ষতার কথা আসলে সর্বকালের সেরা হলেন রোনালদো, মেসি-রোনালদো (পর্তুগাল) কেনো পৃথিবীর আর কেউ এই দিক দিয়ে রোনালদোর পাশে আসতে পারবে না।’ কথাটা কি ভুল বলেছেন মরিনহো? একটু খতিয়ে আসি চলুন।
১৬ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবলের অভিষেক ম্যাচেই করে বসেন পাঁচ গোল, প্রথম ম্যাচ দিয়েই চলে আসেন লাইম লাইটে। ওই মৌসুমেই সেরা গোলদাতা হয়ে ক্লাবকে ট্রফি জেতান। পরের মৌসুমে পাড়ি জমান ইউরোপে। ডাচ লিগে পিএসভির হয়ে গোলের রেকর্ড ভেঙে, দলকে প্রায় সবকিছু জেতান।
ইতিহাসের কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে ফিফার বর্ষসেরা পুরষ্কার ঘরে তোলেন। ইউসিএলে লেভারকুসেনের বিপক্ষে তার অসাধারণ হ্যাটট্রিক দেখে কিংবদন্তি রুডলফ বুটলার বলেন, ‘আমি আজ পর্যন্ত ১৮ বছরের কাউকে এমন ফুটবল খেলতে দেখি নি।’
দুই মৌসুম পিএসভিতে খেলার পর ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ট্রান্সফার ফি তে তাঁকে কিনে নেয় বার্সেলোনা। প্রথম মৌসুমেই করেন ক্লাব ইতিহাসের রেকর্ড ৪৭ গোল। তার সাথে লা লিগা সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার পিচিচি অ্যাওয়ার্ড। তখন কাতালান মিডিয়ায় তাঁকে নিয়ে লেখা হয়, ‘পেলে ফিরে এসেছে।’
কস্পোস্টেলার এর সাথে তাঁর ঐতিহাসিক গোলের পর, নাইকির বিজ্ঞাপনে তাঁকে নিয়ে বলা হয়, ‘Imagine You Asked God To Be The Best Player In The World & He Listened To You.’
এক মৌসুম বার্সায় কাটানোর পর ইতালিয়ান জায়ান্ট ইন্টার মিলান তাকে সেই সময়ের রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে কিনে নেয়। ইতিহাসের প্রথম ফুটবলার হিসেবে মাত্র ২০ বছর বয়সে টানা দু’বার ট্রান্সফার ফি’র বিশ্ব রেকর্ড ভাঙেন তিনি। সে বছরই আবার টানা দ্বিতীয় বারের মতো ফিফার বর্ষ সেরার পুরষ্কার জেতেন৷ মাত্র ২১ বছর বয়সে সর্ব কনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে জেতেন প্রথম ব্যালন ডি’অর।
রোনালদো নাজারিও পৃথিবীর একমাত্র খেলোয়াড় যিনি বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল এবং গোল্ডেন বুট জয়লাভ করেন। ক্যারিয়ারে অর্জনের অভাব নেই, সেই সাথে আছে ভয়ংকর ট্র্যাজেডি। ক্যারিয়ারের পিক টাইমের প্রায় চার বছরই ছিলেন ইনজুরিতে। দুই দুইবার এমন ইনজুরিতে পড়েন যেখান থেকে ফুটবলে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের ফাইনালটা খেলেছিলেন ভয়ংকর ইনজুরি নিয়ে।
১৯৯৯ সালে হাঁটু ভেঙে যায়, ২০ সাপ্তাহ ছিলেন মাঠের বাইরে, ফিরে আসার কয়েকদিনের মধ্যে আবার হাঁটু ভেঙে যায়, এবার দুই বছরের জন্য মাঠের বাইরে চলে যান। তার ফুটবলে ফেরার আশা অনেকে ছেড়ে দিয়েছিল। সবাই বলে দিয়েছিল ‘রোনালদো শেষ!’
অথচ রোনালদো শুধু ফিরেই আসেননি বরং ফিরে এসে ইতিহাস তৈরী করেছিলেন ৷ ২০০২ বিশ্বকাপে দলে ফেরেন এবং সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতান। কে বলবে এই লোক শেষ তিন বছর ক্যারিয়ার এন্ডিং ইনজুরিতে ছিল? অনেকে এই গল্প শুনলে বলবে যেন কোনো সিনেমার কাহিনী বলছি ৷
ক্যারিয়ারে ৮৮ টি গোল করেন ডি বক্সে গোলরক্ষককে ড্রিবল করে। কিংবদন্তি সব গোলরক্ষকদের কাছে আজ ও সবচেয়ে বড় আতংকের নাম রোনালদো। ম্যাজিকাল স্কিলের কথা আসলে অনেকে রোনালদিনহো অথবা মেসির উদাহরণ টানেন, অথচ সেই রোনালদিনহো বলেন, ‘রোনালদো আমার আইডল, তার মতো কেউ হতে পারবে না, হি ইজ এ ম্যাজিক।’
আর লিওনেল মেসির হিরো কে জানেন? এই রোনালদো নাজারিও। মেসির মতে রোনালদো হলেন সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার।
কিংবদন্তি জিদান কে প্রশ্ন করা হলো আপনার কাছে সেরা খেলোয়াড় কে? এক সেকেন্ড সময় না নিয়ে বলেছিলেন রোনালদো। ইব্রাহিমোবিচ কিংবা থিয়রি হেনরি সময়ের শ্রেষ্ঠ এই স্ট্রাইকারদের আইডল হলেন রোনালদো। ইব্রা বলেন, ‘আমি পেলে কে খেলতে দেখি নি, আমার কাছে সর্বকালের সেরা রোনালদো, তিনি অনবদ্য, তিনি ফেনোমেনন।’ বুফন বলেছিলেন, ‘যদি ইনজুরি রোনালদোর ক্যারিয়ারে বাধা হয়ে না দাঁড়াতো তবে সে পেলে কিংবা ম্যারাডোনার চেয়েও গ্রেট হতে পারতো।’
ওল্ড ট্রাফোর্ড এ গিয়ে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। পুরো স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়েছিল।জাতীয় দল, ভিন্ন ভিন্ন ক্লাব, লিগ – সব জায়গায় শুধু সফলই ছিলেন না বরং রেকর্ড ব্রেকার ছিলেন। তার সেই ম্যাজিকাল স্কিল, তার সেই অনবদ্য সেলিব্রেশন, সেই আনকমন হেয়ার স্টাইল সবকিছুই ছিল আইকনিক। ২০০২ বিশ্বকাপের পর দক্ষিণ এশিয়াতেও রোনালদোর আদলে চুল কাটার হিড়িক লেগেছিল।
এই মানুষটা ফুটবল এর স্টাইল টাই বদলে দিয়েছিলেন। আমরা যারা ৯০ দশকে প্রজন্ম তাঁদের ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা জন্মানোর একটা বড় কারণ ‘রোনালদো নাজারিও দ্য ফেনোমেনন!’