রুডি কোয়ের্তজেন একজনই ছিলেন!

১০৮টি টেস্ট ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছেন, ২০৯টি ওয়ানডেতেও আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেছেন। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩৩১টি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন তিনি। বিশ্বকাপ ফাইনালে আম্পায়ার ছিলেন; নির্বাচিত হয়েছিলেন বিশ্বের সেরা আম্পায়ার। বলা হচ্ছে আম্পায়ার রুডি কোয়ের্তজেনের কথা, যিনি ছিলেন বিশ্বসেরাদের একজন।

নিজের আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারে নি:সঙ্গ শেরপার মত অজস্র ব্যাটসম্যানকে তর্জনী আঙুল তুলে প্যাভিলিয়নের রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এবার তাঁকে বিধাতা আউটের সংকেত দেখিয়ে দিল। ৭৩ বছর বয়সে জীবন নামক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিলেন রুডি কোয়ের্তজেন। ব্যাট প্যাড গুছিয়ে ধীর পায়ে চলে গিয়েছেন সাইড লাইনের বাইরে।  

১৯৯২ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত একটানা ১৮ বছর আম্পায়ার হিসেবে নিজের কাজ করে গিয়েছেন রুডি কোয়ের্তজেন। ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা এবং সম্মানিত ম্যাচ অফিশিয়ালদের একজন ছিলেন তিনি। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচে ফিক্সিং করার জন্য ঘুষের প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করেননি ব্যাট-বলের খেলাটির সাথে। 

২০১০ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের চাকরিকে বিদায় বললেও সর্বশেষ রুডি কোয়ের্তজেনকে ম্যাচ পরিচালনা করতে দেখা গিয়েছে ২০১১ সালে। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) সেবার আম্পায়ার ছিলেন তিনি। এরপরই বিরতিহীন অবসরে বেরিয়ে পড়েন। কর্মজীবনে বছরের অধিকাংশ সময় বাইরে বাইরে থাকা রুডি ফিরে যান পরিবারের কাছে।

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আম্পায়ারিং থেকে অবসর নেয়ার পর একটা বই লিখেছিলেন রুডি কোয়ের্তজেন। নাম ছিল ‘স্লো ডেথ: মেমোরিজ অব অ্যা ক্রিকেট আম্পায়ার’। আম্পায়ার থাকাকালীন তাকেও ডাকা হতো স্লো ডেথ নামে। তবে নিজের নাম কিংবা বইয়ের মত ধীর গতিতে নয়, রুডি সবাইকে ছেড়ে গিয়েছেন হুট করেই। 

গত সপ্তাহে বন্ধুদের সাথে একটি গলফ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন রিভারডেল-এ। আরো একদিন আগেই বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাড়তি একটি গলফ প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। তাই থেকে গিয়েছিলেন আরেকদিন। 

আর সেখানেই ৯ আগস্ট তারিখে গাড়ি দুর্ঘটনার মাধ্যমে মৃত্যু এসে ডাক পাঠাল ৭৩ বছরের রুডি কোয়ার্টজেনকে। গাড়িতে তাঁর সাথে অবশ্য আরো কয়েকজন ছিলেন। তবে নিয়তি শুধুই রুডিকেই চেয়ে নিয়েছেন। 

রুডি কোয়ের্তজেন, নামটা রুডি হলেও বাস্তবে মোটেও রুড নন তিনি। খেলার মাঠে আম্পায়ার সুংব গাম্ভীর্য ধরে রাখেন ঠিকই; মাঠের বাইরে একেবারে হাসিখুশি একজন। সহকর্মী, খেলোয়াড় কিংবা সাংবাদিক সবার কাছেই প্রিয়মুখ ছিলেন রুডি কোয়ের্তজেন। 

এক সময়ের সহকর্মী এবং বিখ্যাত আম্পায়ার আলিম দার বলেছেন, ‘রুডির মৃত্যু তাঁর পরিবার, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ক্রিকেটের জন্য শোকের বিষয়। আমি তার সাথে অনেক খেলা পরিচালনা করেছিলাম। তিনি শুধু আম্পায়ার হিসেবেই খুব ভালো ছিলেন না, একজন চমৎকার সহকর্মীও ছিলেনমাঠে সব সময় খুব সহযোগিতা করতেন এমন কি মাঠের বাইরেও সাহায্য করতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর এসব স্বভাবের কারণে সবার কাছেও তিনি সম্মানিত ছিলেন।’

আরেক স্বদেশী আম্পায়ার মারাইস ইরাসমাস রুডি কোয়ের্তজেনের স্মৃতিচারন করেছেন। এছাড়া বীরেন্দর শেবাগদের মত তারকা ক্রিকেটারদের হৃদয়ে তাঁর মৃত্যুতে শোকের দীর্ঘ নেমে এসেছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেবাগ বলেন, ‘আমি ঝুঁকি নিয়ে শট খেললেই তিনি বলতেন ধরে খেলতে। তিনি একজন ভদ্রলোক এবং চমৎকার একজন মানুষ। আপনাকে মিস করবো, রুডি।’

বিতর্কিত কোন কাজের সঙ্গে জড়িয়ে কোন গল্প সৃষ্টি হয়নি রুডি কোয়ের্তজেনের জীবনে। ক্রিকেটীয় নিয়মকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেই যথাসম্ভব নিরপেক্ষ হয়ে দায়িত্ব পালন ছিল তাঁর ব্রত।  কিন্তু চাঁদের গায়েও তো কলঙ্কের দাগ আছে; দাগ আছে রুডি কোয়ের্তজেনের ক্যারিয়ারেও। ২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালের সেই নাটকীয়তার দিন টিভি আম্পায়ার ছিলেন রুডি। 

আলোকস্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কাকে শেষ তিন ওভারে ব্যাট করতে বাধ্য করেছিলেন ম্যাচ অফিশিয়ালরা। অথচ ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে দ্বিতীয় ইনিংসের কমপক্ষে ২০ ওভার হলেই খেলার মীমাংসা হয়ে যায় – সেটি অভিজ্ঞ আলিম দার, বাকনরের মত রুডি কোয়ের্তজেনও ভুলে গিয়েছিলেন।

শাস্তিস্বরূপ ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিষিদ্ধ হয়ে থাকতে হয়েছিল এই দক্ষিণ আফ্রিকানকে।

তবে এসব নেতিবাচক কারনে রুডি কোয়ের্তজেনকে মনে রাখলে অবিচার হবে। তিনি স্মরণে থাকবেন তাঁর সততার জন্য, তিনি অম্লান থাকবেন ক্রিকেটের প্রতি তাঁর নি:স্বার্থ ভালবাসার জন্য। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link