হৃদয়ের জন্য বদলে গেল নিয়ম, চাকরি ছাড়ছেন এলিট আম্পায়ার!

এই সৈকতই  বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র আইসিসি এলিট প্যানেলের আম্পায়ার। তাঁর এই সরে দাঁড়ানো কেবল এক চাকরি ছাড়ার গল্প নয়, এটি একটি মূল্যবোধের গল্প। একটি অবস্থান নেওয়ার গল্প। তাঁর মুখে না-থাকলেও চোখে ছিল প্রতিবাদ, তাঁর চুপ থেকেও যেন বলছিলেন, ‘আপনারা যদি নিয়মকে খেলনার মতো ভাবেন, তবে এই খেলায় আর আমি নেই।’

অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ আটকানো তো দূরের কথা, খোদ বাংলাদেশ ক্রিকেটই যেখানে নীতিবিরুদ্ধ কাজে ব্যস্ত তখন আওয়াজটা আসার দরকার ছিল আম্পায়ারদের পক্ষ থেকেই। সেটাই হল। তাওহিদ হৃদয়ের অসদাচারণের জন্য ম্যাচ রেফারির কাছে অভিযোগ তোলা আম্পায়ার শরফুদৌল্লা ইবনে শহীদ সৈকত বিসিবির চাকরি ছাড়ছেন। অনেকটাই ক্ষুব্ধ হয়েই চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আইসিসির এলিট প্যানেলের এই আম্পায়ার।

ঘটনাগুলো শুরু হয়েছিল স্রেফ একটি তর্ক দিয়ে। মাঠের মাঝে, প্রতিপক্ষ নয় — তর্ক হয়েছিল নিয়মের রক্ষক একজন আম্পায়ার আর সম্ভাবনার এক প্রতীক-চিহ্নিত ব্যাটারের মধ্যে। ক্রিকেটের চেনা ব্যাখ্যায় এটুকু হয়তো অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যা এরপর ঘটেছে, তা অস্বাভাবিক তো বটেই—বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিবেককে কোথাও না কোথাও প্রশ্নবিদ্ধ করেও দিয়েছে।

তাওহিদ হৃদয় তরুণ, আগ্রাসী, প্রতিভাবান। কিন্তু তিনি যে নিয়ম ভেঙেছেন, সে নিয়ম পরে আবার নতুন করে গড়া হয়েছে—শুধু তাঁর জন্য। শুনতে সিনেমার চিত্রনাট্য মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তব বড় নির্মম। কারণ, এই গল্পে কেউ একজন হারিয়েছেন তাঁর আস্থা, কেউ ছিঁড়ে ফেলেছেন পদ-পত্র, কেউ ছেড়ে দিচ্ছেন গৌরবময় দায়িত্ব।

আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে আম্পায়ার শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ সৈকতের সঙ্গে হৃদয়ের বিতণ্ডা, ম্যাচশেষে তাঁর প্রতি বিতর্কিত মন্তব্য, আর তার প্রেক্ষিতে পাওয়া নিষেধাজ্ঞা — সব মিলিয়ে সেটি ছিল ‘খেলার শৃঙ্খলা’র কাছে এক কঠিন পরীক্ষা। ৭ ডিমেরিট পয়েন্ট, দুই ম্যাচ নিষেধাজ্ঞা—সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু, মোহামেডানের ৯ জন ক্রিকেটার নেই, দল গড়তে হিমশিম খাচ্ছিল — এই মানবিক বাস্তবতা কি একটি দেশের ক্রিকেটের নীতিমালাকে বদলে দেওয়ার মতো যথেষ্ট?

হৃদয় এক ম্যাচ নিষেধাজ্ঞা কাটালেন। দ্বিতীয় ম্যাচের আগে এক চিঠি এল। সেই চিঠিতে বলা হল, তিনি খেলতে পারবেন। আম্পায়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান ইফতেখার রহমানের সম্মতির কথা জানিয়ে ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন একই কমিটির ইনচার্জ অভি আবদুল্লাহ আল নোমান। চিঠিতে পরিষ্কার লেখা আছে, ‘অন বিহাফ অব আম্পায়ার্স কমিটি চেয়ারম্যান’।

যদিও আম্পায়ার্স কমিটিরও তাওহিদের শাস্তি কমানোর এখতিয়ার থাকার কথা নয়। সেটা ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিস (সিসিডিএম) কিংবা টেকনিক্যাল কমিটির হাতে থাকা উচিৎ। নতুন জট পাকিয়েছে মোহামেডানের কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম টিটুর ভিন্ন একটি ব্যাখ্যা, যার ক্রিকেটীয় যুক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন। তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘তাওহিদের এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করা হয়েছে। সেটি কার্যকর চলতি কিংবা পরের মৌসুমে হতে পারে।’

সিসিডিএম, টেকনিক্যাল কমিটি, আম্পায়ার্স প্যানেল—সবাই যেন এক ধাঁধায় ঢুকে পড়ল। আর সেই ধোঁয়াশার মধ্যে দিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন হৃদয়। মাঠে নেমে গেল কিছু প্রশ্নও, যার জবাব দিতে আজ নিশ্চুপ পুরো কাঠামো। এই নীরবতায় সবচেয়ে বড় শব্দ করে বাজল দুটি পদত্যাগ। একদিন আগে টেকনিক্যাল কমিটির চেয়ারম্যান এনামুল হক মনি বিদায় জানালেন, শরফুদ্দৌলা সৈকতও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।

এই সৈকতই  বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র আইসিসি এলিট প্যানেলের আম্পায়ার। তাঁর এই সরে দাঁড়ানো কেবল এক চাকরি ছাড়ার গল্প নয়, এটি একটি মূল্যবোধের গল্প। একটি অবস্থান নেওয়ার গল্প। তাঁর মুখে না-থাকলেও চোখে ছিল প্রতিবাদ, তাঁর চুপ থেকেও যেন বলছিলেন, ‘আপনারা যদি নিয়মকে খেলনার মতো ভাবেন, তবে এই খেলায় আর আমি নেই।’

Share via
Copy link