ব্যাপারটা ঘটলো আসলে দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেরা একটু বিপদে পড়ায়। শুরুতেই ওয়ানডে সিরিজ হেরে বসলো তারা বাংলাদেশের কাছে। ঘরের মাটিতে সফরকারী বাংলাদেশের বিপক্ষে এই হার হজম করার আগেই খবর এলো, তাদের সেরা বেশিরভাগ ক্রিকেটার টেস্টে খেলবেন না।
বিশেষত শীর্ষ তিন ফাস্ট বোলার কাগিসো রাবাদা, লুঙ্গি এনগিডি ও এনরিক নরকে অনুপস্থিত থাকলেন বাংলাদেশের বিপক্ষে। এই বাংলাদেশকেও তারা হালকা ভাবে নিতে পারছিলো না। কিছুদিন আগে তারা নিউজিল্যান্ডে টেস্ট জিতে এসেছে। বাংলাদেশের পেসাররা, বিশেষ করে তাসকিন আহমেদ ও এবাদত হোসেন তখন দারুন বল করছেন।
এ অবস্থায় দক্ষিণ আফ্রিকা কী করতে পারতো?
অনেক কিছুই করতে পারতো। কিন্তু যেটা তারা করলো, সেটা ছিলো অপ্রত্যাশিত। তারা একেবারেই রনকৌশল পাল্টে স্পিনে কুপোকাত করতে চাইলো বাংলাদেশকে। যে বাংলাদেশ কি না, দেশের মাটিতে সারা বছর ‘স্পিন’ খেলে বলে শোনা যায়, যে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা স্পিন বিশেষজ্ঞ এবং যে বাংলাদেশের স্পিনাররা ম্যাচ জেতাতে সিদ্ধহস্ত; তাদের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা স্পিন দূর্গ বানালো!
পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পর দক্ষিণ আফ্রিকা নিজের মাটিতে দু জন ফ্রন্টলাইন স্পিনার নিয়ে টেস্ট খেলতে নামলো এবং পরের টেস্টেও সেটা ধরে রাখলো। কয়েক দশক পর দক্ষিণ আফ্রিকা নিজের মাটিতে স্পিনারের হাতে নতুন বল তুলে দিলো। আর এসবের ফল হচ্ছে, চার ইনিংসে বাংলাদেশের ৪০ উইকেটের মধ্যে ২৯টিই তুলে নিলেন দুই স্পিনার কেশব মহারাজ এবং সাইমন হারমার।
এই স্পিন বিষে নীল বাংলাদেশ দুই টেস্টে দু বার শত রানের নিচে অলআউট হলো। প্রথম টেস্ট ২২০ রানে এবং দ্বিতীয় টেস্ট ৩৩২ রানে হারলো বাংলাদেশ।
একটু স্পিন লড়াইয়ের ফলটা দেখুন। দক্ষিণ আফ্রিকান স্পিনারদের ২৯ উইকেটের বিপরীতে বাংলাদেশী স্পিনারদের দুই টেস্টে শিকার ১৮ উইকেট। আবার স্পিনের বিপক্ষে এই দমবন্ধ খেলায় দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানরা য়েকানে অনায়াসে রান করে গেলেন, বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা ছটফট করে মরলেন।
দুই টেস্ট মিলিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের দু জন মাত্র ব্যাটসম্যান ৫০ পার করা ইনিংস খেলতে পেরেছেন ৪ বার করে সুযোগ পেয়ে। বিপরীতে ডিন এলগার একাই ৩ বার পঞ্চাশ পার করা ইনিংস খেলেছেন।
এখন আমরা এতো কথা বলছি কেনো? এসব পরিসংখ্যান দিয়ে কী বোঝাতে চাচ্ছি?
বোঝাতে চাচ্ছি যে, দক্ষিণ আফ্রিকা আসলে ‘আমরা স্পিন ভালো খেলি’ এই মিথটা একদম গুড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা না পেরেছেন স্পিন খেলতে, না স্পিন সহায়ক উইকেটে বাংলাদেশের স্পিনাররা ত্রাস হয়ে উঠতে পেরেছেন।
কিন্তু এমনটা কেনো ঘটলো?
বাংলাদেশ তো বলা হয় স্পিনে ভর করে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডকে টেস্ট হারিয়ে দেয়। ঘরের মাঠে মুমিনুলরা গণ্ডায় গণ্ডায় সেঞ্চুরি করেন স্পিনের বিপক্ষে। তাহলে ডারবান বা পোর্ট এলিজাবেথের স্পিনে কী হলো?
এটাই আসল মজা। বাংলাদেশ ঘরের মাঠে যেটা খেলে, সেখানে সত্যিকারের স্পিন উইকেটও থাকে না; বাংলাদেশের ঝুলিতে সত্যিকারের টার্নারও নেই।
বাংলাদেশে যে উইকেট বানিয়ে আমরা অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডকে হারাই সেটা আসলে স্পিন উইকেট নয়, নিম্নমানের উইকেট। ওই উইকেটে বল পড়ে ধীর হয়ে যায়, বল থাকে হাটুর নিচে। এই লো ও স্লো উইকেটে বাংলাদেশের টার্নহীন স্পিনাররা ত্রাস হয়ে ওঠেন। এখানে আসলে অপকৌশল অবলম্বন করা হয়।
সত্যিকারের স্পিন সহায়ক উইকেটে থাকবে জেনুইন টার্ন, থাকবে বাউন্স। আর সেটাই ছিলো ডারবান ও পোর্ট এলিজাবেথে। এই উইকেট থেকে আপনার ফায়দা নিতে গেলে দলে টার্নার থাকতে হবে, এমন বোলার থাকতে হবে, যে বাউন্সকে কাজে লাগাতে পারে। দুঃখের বিষয় বছরের পর বছর নিম্নমানের উইকেটে খেলে আমরা এখন আর রফিক, রাজ্জাক মানের টার্নারও তৈরি করতে পারছি না।
ফলে নিজেরা হয়ে উঠেছি ‘সো কলড’ স্পিন রাজা। সত্যিকারের স্পিন পরিবেশে ও স্পিনারদের সামনে পড়লে যারা পালানোর পথ খুজে পায় না। আর সেই উইকেটে এমন লজ্জার পর অধিনায়ক মুমিনুল বাধ্য হয়ে বলেন, ‘আমরা স্পিনে অতো ভালো না। দুই একজন ছাড়া কেউ অতো ভালো স্পিন খেলি না।’
কথাটা তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকা বলিয়েই ছাড়লো!