নিষেধের বেড়াজালে সম্ভাবনার ইতি

অভিষেকেই বাজিমাত। লাল বলে দ্যুতি ছড়িয়ে বনেদি ফরম্যাটে নিজের আগামনের একটা শুভ বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের পেসার শাব্বির আহমেদ। প্রথম টেস্ট সিরিজে ঘরের মাঠে তিনি তুলে নেন পাঁচ উইকেট। প্রতিপক্ষ অবশ্য ছিল সদ্যই টেস্ট ক্রিকেটে গুঁটিগুঁটি পায়ে হাঁটতে শেখা বাংলাদেশ। সবাই হয়ত ভেবেছিল খুব বেশিকিছু তো করে ফেলেননি তিনি। আর তিনি বোধহয় গড়পরতা মানেরই বোলার।

তবে না তিনি যে গড়পরতা মানের বোলার ছিলেন না তাঁর প্রমাণ দিলেন নিউজিল্যান্ডে গিয়ে। তুলনামূলক শক্ত প্রতিপক্ষের বিপক্ষেও সমান পারদর্শীতার প্রমাণ রেখেছিলেন শাব্বির। হ্যামিলটন টেস্টে তিনি ব্ল্যাক ক্যাপসদের পাঁচটি উইকেট পুরেছিলেন নিজের পকেটে। ধীরে ধীরে যেন তিনি পাকিস্তান বোলিং আক্রমণের নির্ভরযোগ্যতা জুগিয়ে নিচ্ছিলেন।

২১ এপ্রিল ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে জন্ম তাঁর। পাঞ্জাবের মাটি বায়ুতে বোধহয় শক্তিমান হয়েই বেড়ে ওঠার কোন গোপন রসদ রয়েছে। প্রায় সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতার একজন বোলার ছিলেন শাব্বির আহমেদ। নিজের উচ্চতার পাশাপাশি বলও ছাড়তেন আরও উঁচু থেকে। প্রায় সাত ফুট উপর থেকে বল ছাড়তেন তিনি। এমন উচ্চতা থেকে আসা বল খেলাটা যে কোন প্রতিপক্ষ ব্যাটারের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়।

তিনি যে প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের বেশ ভুগিয়েছেন তাঁর প্রমাণ মিলে টেস্টে তাঁর পরিসংখ্যান দেখলেই। তিনি খেলেছেন মাত্র ১০টি টেস্ট ম্যাচ। সেখানে তাঁর উইকেটের সংখ্যা ২৩.০৩ গড়ে ৫১টি। তবে টেস্ট ক্রিকেটে পা রাখার বহু আগে থেকেই তাঁর অভিষেক ঘটেছিল ওয়ানডে ক্রিকেটে। রঙিন পোশাকে তাঁর যাত্রা শুরু ১৯৯৯ সালে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একটি ম্যাচ দিয়ে অভিষেক হয়েছিল তাঁর।

এরও প্রায় চার বছর বাদে অর্থাৎ ২০০৩ সালে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লাল বল হাতে ধরার সুযোগ পেয়েছিলন শাব্বির আহমেদ। টেস্ট ক্যারিয়ারের তুলনায় তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারে বোলিং গড়টা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। প্রায় ৩৩ এর বেশি গড়ে তিনি ৩২ ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ৩৩ উইকেট। হয়ত এই পরিসংখ্যান দেখে তাঁকে ভাল বলার সুযোগ নেই। তবে তিনি যে একেবারেই সম্ভাবনাময় ছিলেন না তার বিপক্ষে প্রমাণ তিনি রেখেছিলেন টেস্ট ক্রিকেটে।

তাছাড়া তিনি যৌথভাবে ওয়াকার ইউনুসের সাথে দ্রুততম সময়ে পঞ্চাশ টেস্ট উইকেটে মালিক বনে গিয়ে নিজের সক্ষমতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে। তবে সকল সম্ভাবনা যেন ফিঁকে হতে থাকে সময়ের সাথে। ২০০৫ সালে এক বছরের নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। বোলিং অ্যাকশনের মারপ্যাঁচ আর তাতে ধরা খেয়ে তিনি ক্রিকেট থেকে বিতারিত ছিলেন প্রায় বছর খানেক।

বছরখানেক বাদে তিনি নিজের বোলিং অ্যাকশন ঠিক করে আবার ফেরত আসেন ক্রিকেটে। তবে জাতীয় দলের রাস্তাটা তাঁর জন্য ততদিনে সরু হয়ে গেছে। ঘরোয়া ক্রিকেটটা তিনি চালিয়ে যেতে থাকেন। তবে তাতে জাতীয় দলে আর ঢোকা হয়ে ওঠেনি তাঁর। ২০০৫ সালেই থমকে যায় তাঁর জাতীয় দলের ক্যারিয়ার। যা আর কখনোই সচল হয়নি। মাঝে অবশ্য একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। তবে তা ২০০৭ সালে। সেটাই প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ এবং সেটাই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ।

নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ শাব্বিরের সামনে আসে লোভনীয় এক প্রস্তাব। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে সরে যাওয়া একজন খেলোয়াড়ের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া বেশ কঠিন। তাইতো তিনি লুফে নেন নিষিদ্ধ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগের প্রস্তাব। সেখানে এক মৌসুম কাটান চেন্নাই সুপারস্টার্সে। প্রথম মৌসুম দারুণ কাটে তাঁর। বিপত্তির শুরু হয় পরের মৌসুম থেকে।

অর্থকড়ি নিয়ে ফ্রাঞ্চাইজির সাথে বনিবনা হয়নি তাঁর। এমনকি দ্বিতীয় মৌসুম থেকে সকল খেলোয়াড়দের সাথেই ফ্রাঞ্চাইজিদের সমস্যার শুরু হয়। তবুও শাব্বির আহমেদ কোন ধরণের পারিশ্রমিক ছাড়াই খেলে যাচ্ছিলেন একটা আশায়, যে হয়ত তিনি পাবেন তাঁর প্রাপ্য পারিশ্রমিক। তবে দুর্ভাগ্যবশত কোন ধরণের পারিশ্রমিক ছাড়াই তিনি দ্বিতীয় মৌসুমের পুরোটা খেলেছিলেন ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে।

এরপর থেকে আর আলোকিত করতে পারেননি তিনি নিজের ক্যারিয়ার। অন্ধকারচ্ছন্ন এক সমাপ্তির দিকে ধাবিত হয় শাব্বির আহমেদের ক্যারিয়ার। থমকে থাকা ক্যারিয়ারটার ইতি যেন তিনি নিজেই টেনে দিয়েছিলেন নিষিদ্ধ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে। অথচ তাঁর উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি বনে যেতে পারতেন পাকিস্তানের অন্যতম সেরা বোলারদের একজন। এভাবেই হয়ত নক্ষত্ররা উজ্জ্বল হবার আগেই ঝড়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link