চার-ছক্কার খেলা টি- টোয়েন্টি। বিশ ওভারের খেলায় যে দল যত বেশি বাউন্ডারি হাঁকাবে তারাই জিতবে- আপাতদৃষ্টিতে এমনটা মনে হলেও দৌড়ে রান নেয়ার দক্ষতা যে দলের বেশি শেষ হাসিটা তাদেরই। বিশেষ করে অ্যাডিলেড-মেলবোর্নের বড় মাঠগুলোতে বাউন্ডারি হাঁকানো যেখানে দুষ্কর, সেখানে মাঠের আয়তন কাজে লাগিয়ে দৌড়ে রান নেয়াই ভরসা। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে খেলতে হলে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াও জরুরী।
এক্ষেত্রে ভাল করতে হলে আপনাকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল এবং খুটিনাটিতে নজর দিতে হবে। এই কথাগুলো কিন্তু যার তাঁর কথা নয়, বলেছেন স্বয়ং শচীন টেন্ডুলকার। টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ব্যাটসম্যানদের টোটকা দিয়েছেন কি করে দৌড়ে রান নেয়ার ক্ষেত্রে বাকিদের চাইতে এগিয়ে থাকা যায়। আসুন দেখে নেয়া যাক শচীনের পরামর্শগুলো।
- ব্যাট মাটিতে রাখার দক্ষতা
অস্ট্রেলিয়াতে মূল ড্রপইন পিচে খেলা হবে এবং পিচে ঘাসের ঘনত্বও বেশি থাকবে। এই ধরনের পিচে সাধারণত দুই ধরনের ঘাসের স্তর থাকে। ড্রপইন পিচের মেঝের পাশাপাশি থাকে নরম ঘাসের স্তর। ব্যাটকে মাটিতে রাখতে পারা ব্যাটসম্যানদের একটি বিশেষ দক্ষতা।
চর্চা না থাকলে নরম ঘাসে ব্যাট স্লিপ করে যেতে পারে। ব্যাট কোনদিকে ঘুরানো থাকবে এটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে কোণার দিক। কারণ কোণায় লেগে স্লিপে ক্যাচ উঠে যেতে পারে। এছাড়া ব্যাট ধরার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং আপনি যখন ফ্লিপ এবং স্লাইড করবেন, ব্যাটের গোড়ার অংশ যেন ক্রিজেই থাকে সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। ব্যাটের মুখটা যারা নিচের দিকে রাখেন, তাঁরা বেশ সুবিধা পাবেন। ক্রিজের যেকোনো অংশে তাঁদের ক্যাচ তুলে দেবার সম্ভাবনা বেশ কম।
- স্পাইক তীক্ষ্ণ রাখা
অস্ট্রেলিয়ার পিচের জন্য, আমি লম্বা স্পাইকের পরামর্শ দেব। সত্য কথা বলতে ব্যাট করতে নামার আগে আমি বুটের স্পাইক আরও তীক্ষ্ণ করেই মাঠে নামবো। স্পাইকগুলো ভোঁতা হলে তাঁরা পিচের মেঝেতে অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে তীক্ষ্ণ স্পাইকে বেশ সহজেই বড় বড় এবং দ্রুত পা ফেলা সহজ হয়। আউটফিল্ডে ফিল্ডিংয়ের সময় নরম স্পাইক কাজে দিলেও ব্যাটিং তথা রান নেবার সময় তীক্ষ্ণ স্পাইক অত্যাবশ্যকীয়, স্প্রিণ্টারদের স্পাইকে যে রকমটা দেখা যায়। এই ধরনের ছোট খাটো বিষয় আপনাকে প্রতিপক্ষের চাইতে এগিয়ে দেবে।
এছাড়া আপনি ক্রিজের কোন অংশে দৌড় দিচ্ছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ড্রপইন পিচের দুই পাশ দিয়ে দৌড়ানো বেশ কাজে দেয়। যদি বাঁ-হাতি বোলার বল করার সময় ননস্ট্রাইকার পাশের লাইন নেয় এবং স্ট্রাইক ব্যাটার মাঝের লাইন, তাহলে তাঁদের জন্য সুবিধাজনক হবে। প্রতিটা ব্যাটারই চায় সবচেয়ে কম দূরত্ব অতিক্রম করে রান নিতে। একারণেই দুই ব্যাটারের মাঝে আগে থেকে ঠিক করে রাখা ভাল, কে কোন অংশে দৌড়াবে।
- ‘গো’ কে না বলুন
এমনকি রান কল করার সময় আমরা যেসব শব্দ ব্যবহার করি সেটাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে রানের জন্য ‘গো’ ‘গো’ বললে অনেক সময় সেটা শোনা যায় ‘নো’ ‘নো’ এর মত। এর চাইতে বরং শিওর (অবশ্যই), ওয়েট (অপেক্ষা করো) কিংবা দুইয়ের জন্য দৌড়াবো বলে কল করা শ্রেয়তর।
যেমন ধরুন আপনি কাভারের দিকে বল ঠেলে দিয়েছেন এবং জানেন সেখানে দুই রান হবার সম্ভাবনা প্রবল, তাহলে শুরু থেকেই ‘দুইয়ের জন্য দৌড়াচ্ছি’ কল দিতে পারেন, তাহলে প্রথম রান থেকেই দুই নেবার তাগিদটা বেড়ে যায়। তবে অনেক সময় স্টেডিয়ামভর্তি দর্শকদের গগনবিদারী চিৎকারে কল শোনা যায় না, এক্ষেত্রে দুই ব্যাটারের মধ্যে চোখে চোখে ইশারা করে বুঝে নিতে হয়।
- দ্রুত ঘুরে যাওয়া
কেবল জোরে দৌড়ানোই নয়, বরং কত দ্রুত ঘুরে আপনি রানের জন্য পুনরায় ছুটতে পারছেন সেটাও জরুরি। অনেকেই আছেন যারা দৌড়ে ভাল কিন্তু দ্রুত ঘুরে যেতে কিংবা গতি বাড়াতে জানেন না। আপনাকে নড়াচড়ায় অনেক বেশি নমনীয় হতে হবে। আমি যদি ৬০ মিটারের কোনো দৌড়ে অংশ নেই, তবে অনেকেই আমাকে হারিয়ে নেবে। কিন্তু বাইশ গজে রান নেবার বেলায় তাঁরা আমার সাথে পারবে না, কারণ আমি অতি অল্প সময়েই গতি অনেক বেশি বাড়িয়ে নিতে জানি। ক্রিজের পুরোটাজুড়ে গতি বাড়িয়ে দৌড়ানো কিংবা দ্রুত ঘুরে যাওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়।
- ব্যাট মাটিতে রাখা অত্যন্ত জরুরি
যে জায়গায় আপনি ব্যাট রাখবেন সেটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একজন ব্যাটারকে চোখ বন্ধ করলেও বুঝে ফেলতে হবে ক্রিজের কতোটা কাছে রয়েছেন। এটা জানা জরুরি যে আপনি কতটুকু সময়ের মাঝে পপিং ক্রিজে ঢুকে যেতে পারবেন।
অনেক সময় দেখা যায় ব্যাটাররা পপিং ক্রিজের বেশ ভেতরে থাকেন, ফলে রান নেবার সময় মূল্যবান কয়েক মিলিসেকেন্ড নষ্ট হয়ে যায়। ধরুন মাত্র চার ইঞ্চির জন্য আপনি রান আউট হয়ে গেলেন, তখন নিজেকে আপনার দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গাধা মনে হবে।
- মেলবোর্নে চার রান নিয়েছিলাম
১৯৯৯ সালে মেলবোর্নে শতরান পূর্ণ করার পরের ঘটনা এটি। তখনকার দিনে বাউন্ডারি একেবারে গ্যালারির কাছাকাছি ছিল। শেন ওয়ার্নের একটি বল ব্যাকফুটে গিয়ে পুল করি, আমি ভেবেছিলাম বোধহয় চার হয়ে যাবে। তবে বাউন্ডারির কাছে গিয়ে বলটি থেমে যায় এবং রিকি পন্টিং যখন বল কুড়িয়ে থ্রো করে তখন আমি চতুর্থ রানের জন্য দৌড়ানো শুরু করেছি। আমি জানতাম এতোটা দূরত্ব পাড়ি দিয়ে আসার আগেই আমি রানটা সম্পন্ন করতে পারবো।
মাঠ তাই দ্রুতগতির নাকি খানিকটা ধীর এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ধরা যাক আপনি মিড অফে বল ঠেলে রানের জন্য দৌড়ালেন। ধীরগতির পিচে আপনি সব সময় দুই নিতে পারলেও, দ্রুতগতির পিচে তা হয়ে ওঠে না।
- বাতাসের গতিপ্রকৃতি বুঝতে পারা
অস্ট্রেলিয়াতে মনোযোগ দেবার মত আরেকটা জরুরি জিনিস হল বাতাসের গতিপ্রকৃতি। ফিল্ডারের থ্রো বাতাসের গতির বিপরীত দিকে হলে আপনি অনেক সময়ই একটি রান চুরি করতে পারেন। তবে এজন্য আপনাকে বাতাসের দিক গভীর মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, নইলে আপনি ঝামেলায় পড়বেন। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়ার মাঠগুলো বেশ বড়, বাতাসের বিপরীতে মারতে গেলে বাউন্ডারিতে ক্যাচ হবার বড় সম্ভাবনা থাকে।
ব্যাটসম্যানদের আরও বেশি স্মার্ট হতে হবে, বাতাসের দিকে মারলে অনেক সময় মিসটাইমিং এর ক্ষেত্রেও বাউন্ডারি হবার বড় সম্ভাবনা থাকে। এমনকি পাওয়ার প্লের সময়টাতেও ব্যাটারদের বুঝতে হবে সে মাঠের কোন অংশে খেলছে। আমরা অক্টোবরে খেলতে যাচ্ছি, আশা করি সে সময়টাতে পিচ ব্যাটিং সহায়কই হবে।
আমি রবিবার নেদারল্যান্ডসের খেলা দেখছিলাম। বল ভালমত গ্রিপ করা যাচ্ছিল এবং পিচে গতি ছিল। পার্শ্বীয় গতি পাওয়া যাচ্ছিল। এই সময়টাতে সাধারণত বড় শট না খেলে উইকেট ধরে রেখে রানিং বিটুইন দ্য উইকেটের উপর বেশি ভরসা করতে হয়। উইকেটে সেট হয়ে তারপর অনিন্দ্য সুন্দর সব শট খেলার চেষ্টা করতে হবে। যারা পিচের কন্ডিশন ভালভাবে বুঝতে পারবে, তাঁদের জন্য খেলাটা সহজ হয়ে যাবে এবং বুঝতে পারবে কোন ভঙ্গিমায় ব্যাট করতে হবে।
- পার্টনারের গতির উপর ভরসা রাখা
আমি প্রায়ই একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হই যে কার সাথে ব্যাট করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম। পেশাদার ক্রিকেটে এর কোনো উত্তর নেই। এটা হলো অপরপ্রান্তের ব্যাটসম্যানকে বুঝতে পারার বিষয়। দ্রুত রান নেবার ক্ষেত্রে পার্টনারের গতি, পরিস্থিতি ,শক্তিমত্তা এবং দুর্বলতার দিকেও নজর রাখতে হয়। একার কথা না ভেবে বরং দুজনের কথা ভেবে ব্যাট করার কথা ভাবতে হবে।
- স্ট্রাইক রোটেট করা
কেপ টাউনে একবার এক ম্যাচে আমি আর গৌতম গম্ভীর টানা ৫৬ মিনিট স্ট্রাইক রোটেট করিনি। আমি ডেল স্টেইনকে সামলাচ্ছিলাম আর সে মরনে মরকেলকে। সে সময়টাতে আমি জানতাম পরের ওভারের ছয়টি বলই আমাকে খেলতে হবে। তবে টি -টোয়েন্টিতে টানা কয়েক ওভার বল খেলার সুযোগ না পেলে মোমেন্টাম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় ওপেনারদের ক্ষেত্রে একজনই বেশি বলের মুখোমুখি হচ্ছেন। সতর্ক না থাকলে এসব ক্ষেত্রে অপরপ্রান্তের ব্যাটার মোমেন্টাম হারিয়ে ফেলতে পারেন।