দু’জনের কেউ যেন কারো চেয়ে কম নন। একজনের ছিল গতির ধার। আরেকজনের ব্যাটটা হয়ে উঠতো তরবারি। আর দুইয়ের দাপটে মাঠের লড়াইটাও জমতো দারুণ।
এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়ানশিপের একটি ম্যাচে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে শচীন টেন্ডুলকারকে করা শোয়েব আখতারের ক্যারিয়ারের প্রথম বলেই শচীনকে আউট করে সাজঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকেই কি দুজনার নীরব দ্বন্দের শুরুটা? অবশ্য ক্রিকেটের দুনিয়ায় ব্যাটার আর বোলারের সম্পর্কটা সম্পূরক অথচ বিপরীতধর্মী হবে এটাই স্বাভাবিক। আর ব্যাটার ও বোলার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তানের হলে তো কথাই নেই!
ক্রিকেটের মাঠে একজন ছিলেন বিশ্বের দ্রুততম বোলার, যিনি চার বা পাঁচ ওভারের এক স্পেলেই যেকোন ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। অন্যদিকে, শচীন টেন্ডুলকার ছিলেন বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান, বরং বলা উচিত সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। অর্থাৎ একজন আক্রমণকারী বোলার বনাম একজন আক্রমণকারী ব্যাটারের মধ্যকার নীরব যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছিল ক্রিকেট বিশ্ব।
পরিসংখ্যান বলে, শচীন টেন্ডুলকার ১৯৮৯ – ২০১৩ সালের মধ্যে ২০০ টি টেস্টে ৫৩.৭৮ গড়ে ১৫৯২১ রান করেছিলেন। তন্মধ্যে রয়েছে ৫১টি সেঞ্চুরি এবং ৬৮ টি অর্ধশতক। এবং অপরাজিত ২৪৮ রান হলো সেরা স্কোর।
১৯৮৯ থেকে ২০১২ সময়কালে শচীন টেন্ডুলকার ৪৬৩ ওয়ানডেতে ৪৪.৮৩ গড়ে ১৮৪২৬ রানের রেকর্ড করেছেন। যার মধ্যে তিনি ৪৯ টি সেঞ্চুরি এবং ৯৬ টি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। ওয়ানডেতে অপরাজিত ২০০ রান হল তাঁর সেরা ব্যাটিং পারফরম্যান্স। হ্যাঁ, ওয়ানডের ইতিহাসে তিনিই প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান।
ওই দিকে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শোয়েব আখতার ৪৬ টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ২৫.৬৯ গড়ে ১৭৮ টি উইকেট নিয়েছেন এবং এক ইনিংসে মাত্র ১১ রানে ছয় টি উইকেট সেই সাথে এক ম্যাচে ৭৮ রানের বিপরীতে ১১ উইকেট শিকার হলো টেস্টে তাঁর সেরা বোলিং ফিগার। ১২ টি ফাইফার রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।
১৯৯৭ থেকে ২০১১ সময়কালের মধ্যে, শোয়েব ১৬৩ টি ওয়ানডে খেলেছেন যাতে তিনি ২৪.৯৭ গড়ে এবং ৪.৭৬ ইকোনমি রেটে ২৪৭ টি উইকেট লাভ করেছেন। তার সেরা বোলিং পরিসংখ্যান ছিল ১৬ রানে ৬টি উইকেটে। স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ার হলেও বেশ প্রভাবশালী ছিল সময়টা।
টেন্ডুলকার এবং আখতার ক্রিকেট মাঠে বেশ কিছু স্মরণীয় ম্যাচে নীরব দ্বন্দে লিপ্ত হয়েছেন। কখনও কখনও, টেন্ডুলকার সফল হতেন; আবার কখনোবা শোয়েব সাফল্য পেতেন। সেই রকম কিছু গল্পই থাকছে আজ।
১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক সেই টেস্ট। ইডেনের টেস্টে এই রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস খ্যাত শোয়েবের বলেই বোল্ড হয়ে টেন্ডুলকার শূন্য রানে প্রথম ইনিংসে আউট হয়ে যান। যা দেখে পুরো স্টেডিয়াম নীরব হয়ে যায়। শচীনের ক্যারিয়ারের খুবই বিরল এক দৃশ্য।
আবারও ১৯৯৯ সালের জুনে হওয়া বিশ্বকাপের এক ম্যাচে শোয়েব আখতারের মুখোমুখি শচীন। কলকাতায় দু:সাহসিক ঘটনার পর শোয়েব আখতারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ম্যানচেস্টারে আখতারকে তিনি খুব সতর্কতার সাথে খেলেছিলেন। শোয়েবকে এবার আর তাঁর উইকেটটি নেয়ার সুযোগ দেননি। সেই ম্যাচে ৬৫ বলে ৪৫ রান করেছিলেন তিনি।
পরবর্তীতে ২০০৩ সালের মার্চে সেঞ্চুরিয়নে ক্রিকেট বিশ্বকাপের একটি সেমিফাইনাল ম্যাচে শোয়েব আখতারকে পরপর তিনটি দুর্দান্ত শট মেরেছিলেন শচীন। যার প্রথমটি ছক্কা, দ্বিতীয়টি বাউন্ডারি এবং তৃতীয়টি দৃষ্টিনন্দন এক স্ট্রেট ড্রাইভে আবারো বাউন্ডারি।
সেই ম্যাচে ৭৫ বলে ৯৮ টি মূল্যবান রান করেছিলেন ‘লিটল মাস্টার’। শেষ পর্যন্ত শচীনকে আউট করেছিলেন ওই শোয়েবই। ২০০৪ সালের মার্চে করাচীতে ভারতের পাকিস্তান সফরের সময় সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে, শোয়েব আখতার খুব করে শচীনের উইকেটটি নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
একটি ডেলিভারিতে টেন্ডুলকারকে প্রায় ক্যাচ- আউট করেও ফেলেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেটি নো বল বিবেচিত হয়েছিল। নতুন জীবন পেয়ে শচীন একটি ছক্কা এবং পরপরই স্ট্রেট ড্রাইভ দিয়ে উপভোগ করছিলেন। তারপর নবম ওভারে নাভেদ-উল-হাসানের তালুবন্দী করে ২৮ রানে শচীনকে ফেরান শোয়েব। পরের ওয়ানডে ম্যাচে শচীন টেন্ডুলকার ১৪১ রানের একটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।
তাছাড়া ব্যক্তিজীবনে শোয়েব আখতার ও শচীন টেন্ডুলকার দুজনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একেবারেই দুই মেরুর ছিল। শোয়েবের দুর্দান্ত বোলার হিসেবে পরিচিতি থাকলেও তাঁর ক্যারিয়ার ছিল দারুণ বিতর্কিত। অবৈধ ড্রাগ গ্রহণ, অবৈধ বোলিং অ্যাকশন, সতীর্থের সাথে হাতাহাতি সবকিছুর জন্য তিনি বারবার বিতর্কিত ও নিষিদ্ধ হয়েছিলেন।
অন্যদিকে, শচীন টেন্ডুলকার হলেন ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম ‘নিট অ্যান্ড ক্লিন’ ক্রিকেটার। যাকে ভারতীয়রা ক্রিকেটের দেবতা মানেন। শচীনের ক্যারিয়ারে অর্জনের ঝুলিটা অনেক ভারি হলেও কলঙ্কের রেখা লাগতে দেননি তিনি নিজের নামের পাশে। পরস্পরের থেকে সব দিক থেকেই যোজন যোজন দূরে অবস্থান করেও তাঁদের দ্বৈরথের এই নজীর লেখা হয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়।