অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি বোলার গ্লেন ম্যাকগ্রা একদফা বলেছিলেন যে সনাথ জয়াসুরিয়া নাকি তাঁর জন্যে ছিলেন বেশ শক্ত এক প্রতিপক্ষ। নিজের ক্রিকেটিয় সামর্থ্যের প্রমাণ রেখেই সনাথ জয়াসুরিয়া আদায় করে নিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের সমীহ। শুধু প্রতিপক্ষ যেন নয়। তাঁকে সমীহ কিংবা সম্মান করে পরবর্তী প্রজন্ম থেকে শুরু করে আপামর ক্রিকেট দর্শক।
করবেই বা না কেন বলুন। তাঁর মত ব্যাটারদের তো আর সচারচর দেখা মেলে না। যারা কিনা একটা সংস্করণের পুরো ধারণাই বদলে দেবেন। হ্যাঁ, যদি এ কথা বলি যে ওয়ানডে ক্রিকেটের নতুন এক ধারা শুরুর বাহক হিসেবে কাজ করেছেন সনাথ জয়াসুরিয়া তাহলে নিশ্চয়ই খুব একটা ভুল বলা হবে না। শুধু যে তিনি বাহক হয়েছিলেন তা নয়, তিনি সে পরিবর্তন নিজের মধ্যে ধারণও করেছিলেন।
১৯৯৩ এর আগে ধারণা করা হত যে হার্ডহিটার ব্যাটাররা থাকবেন শেষের দিকে স্লগ করার জন্যে। আরেকটু যদি নির্দিষ্ট করে বলতে চাই তাহলে পিঞ্চ হিটার শব্দটা এখানে যথার্থ হয়। কিন্তু সে ধারার আমুল পরিবর্তন করে দিয়ে গেছেন যেন জয়াসুরিয়া। তিনি যেন প্রমাণ করে গেছেন পিঞ্চ হিটাররা শুধু ইনিংস শেষ না, তাঁরা ইনিংস শুরুও করতে পারেন দারুণভাবে।
সনাথ জয়াসুরিয়া তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একজন পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার হিসেবে। না তিনি যে তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় বনে গিয়েছিলেন ব্যাটার তা কিন্তু নয়। তবে ক্যারিয়ারের শুরু থেকে যে জিনিসটা পরিবর্তন হয়েছে সেটা হচ্ছে ব্যাটিং পজিশন এবং তাঁর পরিসংখ্যান। এই যে সাম্প্রতিক সময়ে সুনীল নারাইনের মত ব্যাটাররাও ওপেনিং-এ নেমে সাফল্য পাচ্ছেন। এর পেছনে কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও জয়াসুরিয়ার অবদান রয়েছে।
জয়াসুরিয়া স্বাভাবিকভাবেই অলরাউন্ডার হওয়ার সুবাদে খেলতেন লোয়ার মিডল অর্ডার থেকে শুরু করে লোয়ার অর্ডারে। তবে ১৯৯২ সালে আইসিসি কর্তৃক নতুন ফিল্ডিং আইন প্রণয়ন করা হলেই যেন ভাগ্য খুলে যায় জয়াসুরিয়ার। তিনিই যেন ছিলেন সেই ফিল্ডিং আইনের ফায়দা তুলে নেওয়ার অন্যতম এক কারিগর। তবে এই কাজটা যে তিনিই আগে শুরু করেছিলেন বিষয়টা তেমন নয়।
প্রথম পাওয়ার প্লের সুবিধা নিয়ে দ্রুত রান তোলার বিষয়টা সর্বপ্রথম রপ্ত করেছিলেন নিউজিল্যান্ডের মার্ক গ্রেটব্যাচ। তিনি কি করে ব্যবহার করা যায় সেটা শিখিয়েছিলেন। আর অন্যদিকে এই বিষয়টাকে রপ্ত করা নয় শুধু, এটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন জয়াসুরিয়া। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে এর পূর্ণ সুবিধাটুকু পেয়েছিল লংকান ক্রিকেট। আর বনে গিয়েছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
অপ্রত্যাশিতভাবে নিন্দুকদের মুখে কুলুপ এঁটে দিয়ে অর্জুনা রানাতুঙ্গার দল জিতে নিয়েছিলেন নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ। অথচ এর আগে অবধি শ্রীলঙ্কা প্রথম পর্বই পার করতে হিমসিম খেয়ে যেত। আর সেবারের সে শিরোপা জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সনাথ জয়াসুরিয়া। ইনিংসের শুরু থেকেই রমেশ কালুভিতারানারাকে সঙ্গী করে প্রতিপক্ষ বোলারদের উপর চড়াও হতেন তিনি।
যদিও তিনি টুর্নামেন্ট শেষ করেছিলেন কেবল ২২১ রানে। সেবারের আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। তিনি করেছিলেন ৫২৩ রান। জয়াসুরিয়া সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক না হতে পারলেও তাঁর বেশকিছু ইনিংস শ্রীলঙ্কার জয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। ভারতের বিপক্ষে তাঁর দ্রুতগতির ৭৯ রান শ্রীলঙ্কাকে ছয় উইকেটে জয় তুলে নিতে সহয়তা করেছিল। অন্যদিকে তাঁর করা ৪৪ বলে ৮২ রানের সুবাদে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয় পায় লংকানরা।
তবে রানের বিচারে জয়াসুরিয়ার ১৯৯৬ বিশ্বকাপের অবদানকে যাচাই করা সম্ভব নয়। তিনি যেন একটা ‘ট্যাবু’ ভেঙে প্রমাণ করেছিলেন যে পাওয়ারপ্লে-তে পিঞ্চ-হিটিং ঠিক কতটা কার্য্যকর হতে পারে। পাওয়ার প্লেতে সেবার শ্রীলঙ্কা ভারত, কেনিয়া ও কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সংগ্রহ করেছিল যথাক্রমে ১১৭, ১২৩ ও ১২১। এই সংগ্রহগুলো শ্রীলঙ্কার মিডল অর্ডারকে খানিকটা নির্ভার হয়ে খেলতে সহয়তা করেছিল।
পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই তিনি প্রায় ১৩২ এর কাছাকাছি স্ট্রাইকরেটের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন। সেই ওপেনিংয়ে পিঞ্চ হিটার হিসেবে নামার পর তিনি তাঁর ক্যারিয়ার শেষ করে ১৩৪৩০ রানের একটা বিশাল পরিসংখ্যান নিয়ে। অথচ তার আগে জয়াসুরিয়ার সর্বোচ্চ সংগ্রহ ছিল ৩৪ রানে অপরাজিত।
তবে ওই যে একটা বিশ্বকাপে তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেলেন পিঞ্চ হিটারদের দিয়েও ওপেনিং করা যায়। আর তাঁরা যদি হয় দক্ষ তবে তো আর কথাই নেই। এই টি-টোয়েন্টির যুগে পিঞ্চ হিটারদের দিয়ে ওপেনিং করানোটা যেন রীতিমত সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে গেছে। তবে ওয়ানডে ক্রিকেটের ব্যাকারণে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তিনি পেতে পারেন।
শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট কিংবা সে সময়ের অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গাও কৃতিত্বের দাবিদার। তাঁরা ভরসা রেখেছিলেন জয়াসুরিয়ার উপর। আর জয়াসুরিয়া নিজের সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে নিজেকে প্রমাণ করে দলকে শিরোপা জিতিয়েছেন। সে সাথে ক্রিকেটের এক পরিবর্তন প্রণেতা হয়ে দর্শকদের মনে আলাদা জায়গা তৈরি করে রয়ে গেলেন চির সজীব।