রিয়ালের দু:খ ‘স্যানিতাস’

কথায় আছে চীনের দু:খ হোয়াংহো। কথায় না, একসময় কাজেও চীনের দু:খ ছিল হোয়াংহো নদী। যে নদীর বাঁকে গড়ে উঠেছিল চাইনিজ সভ্যতা, সেই নদীই একদিন হয়ে উঠেছিল তাদের কষ্টের কারণ। হোয়াংহোর বিশাল বিশাল ঢেউ নিয়মিতই আঘাত হানতো বেইজিংয়ে। এখন অবশ্য অনেককিছু করে সেই হোয়াংহো আর আগের হোয়াংহো নেই। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের যদি ‘হোয়াংহো’ বলে কেউ থাকে, সেটা অবশ্যই স্যানিতাস এফসি।

শুরু থেকেই শুরু করা যাক, স্যানিতাস এফসি হলো রিয়াল মাদ্রিদের মেডিক্যাল স্পন্সর। মূলত প্রতিটি দলই তাদের খেলোয়াড়দের সুস্থ সবল রাখার জন্য কোনো একটি মেডিক্যাল টিমের সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকে। আর সেই অনুযায়ী সেই গ্রুপ কিংবা মেডীক্যাল ফ্যাসিলিটি নিজেদের ব্র্যান্ড নেইম প্রচার করে, আর সেই দল লাভ করে মেডিক্যাল সহায়তা। মূলত খেলার মাঠে সাইডবেঞ্চে থাকা মেডিক্যাল স্টাফরা হয়ে থাকেন সেই গ্রুপের সদস্য। স্যানিতাস গ্রুপও রিয়াল মাদ্রিদের মেডিকেল স্পন্সর। স্পন্সর না বলে পার্টনার বললে ভালো শোনায়, কারণ স্পন্সরের ক্ষেত্রে শুধু গিভ থাকে, টেকিং খুব কম থাকে, কিন্তু মেডিকেল পার্টনার হিসেবে স্যানিতাসের সঙ্গে গিভ অ্যাণ্ড টেইক দুটো সম্পর্কই বিদ্যমান।

স্যানিতাসকে রিয়াল মাদ্রিদের মেডিকেল পার্টনার হিসেবে চুক্তিবদ্ধ করা হয় ২০০৭ সালে, র‍্যামন ক্যালরেদনের আমলে। নতুন করে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের আগমণ অনেককিছু চুরমার করে দিলো স্যানিতাসের সাথে চুক্তি ভাঙ্গার কথা ভাবেননি কখনও। সে জন্যই প্রায় ১৫ বছর ধরে রিয়ালের বন্ধু হয়ে আছে স্যানিতাস এফসি। কিন্তু আস্তে আস্তে যতই দিন যাচ্ছে, বন্ধু থেকে গলার কাঁটা হয়ে উঠছে স্যানিতাস এফসি।

গত সপ্তাহের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ম্যাচের কথাই ভাবুন, ইতালিতে যাওয়ার আগে দল বানাতে কী ঝক্কিই না পোহাতে হয়েছে জিদানকে। এমন সব খেলোয়াড়কে নিয়ে বেঞ্চে জায়গা দিতে হয়েছে, যাদের খেলা তো দূরে থাক, নামই শোনেনি অনেকে। সার্জিও আরিব্বাস, ভিক্টর ক্রাস্ট, অ্যান্তোনিও ব্লাংকো, হুগো দুরো, মিগুয়েল ওর্তেগা; নামগুলো রিয়াল মাদ্রিদ কাস্তিয়ার। মূল দলের নয়। আর মূল দলের খেলোয়াড়েরা? তাদের কেউ হাসপাতালে, কেউ রিকোভারিতে, কেউ হাল্কা-পালতা ট্রেনিং করছেন।

সব মিলিয়ে হ-য-ব-র-ল একটা অবস্থা রিয়াল শিবিরে। দলের অধিনায়ক, সহ-অধিনায়ক, তৃতীয় অধিনায়ককে পর্যন্ত চোটের কারণে মাঠে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। বলতেই পারেন খেলোয়াড়ের চোটের সাথে সম্পর্ক দলের খেলার স্টাইল কিংবা ট্রেনিং প্রেশারের উপর। কিন্তু ইনজুরির সংখ্যা হয় ৪১? ৪১ বার চোটে পরেছে রিয়ালের খেলোয়াড়েরা। এর মধ্যে ইডেন হ্যাজার্ডই ৫ বার। চোট থেকে আসতে না আসতেই তাকে বের হয়ে যেতে হয় ট্রেনিং থেকে। গত কয়েক মৌসুমের তুলনায় এই মৌসুমে স্যানিতাস এফসির কার্যক্রম দূর্বিসহ করে তুলেছে জিদানের দলকে। এমনকি রিউমার উঠেছে, জিদানও বিরক্ত এই মেডিক্যাল দলের উপরে। এমন বিরক্তি শূধু জিদানের নয়, ফিরে তাকিয়ে দেখা যাবে এই স্যানিতাস এফসির সাথে রিয়াল খেলোয়াড়দের দ্বন্দ্বটা বেশ পুরোনো।

স্যানিতাসের উপর ভরসা হারানো খেলোয়াড়ের লিস্টটা বেশ লম্বা। শুরু করা যাক রিয়ালের গত দশকের সেরা খেলোয়াড় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে দিয়েই। রোনালদোর মতন ফিটনেস ফ্রিক খেলোয়াড় বর্তমান পৃথিবীতে খুব কমই আছে। কিন্তু সেই রোনালদোর সাথেই যখন মোনোমালিন্য হয় মেডিক্যাল বোর্ডের, তখন অবস্থাটা বুঝুন।

২০১১ সালের মার্চে মালাগার বিপক্ষে চোট পান রোনালদো। দুই সপ্তাহ মাঠের বাইরে থাকার পরে তাকে ছাড়পত্র দেয় রিয়ালের মেডিক্যাল বোর্ড। তা নিয়েই পর্তুগালের হয়ে খেলতে যান তিনি। কিন্তু মাঠে নামার পরেই বুঝতে পারেন, এই ছাড়পত্র শুধু কাগজে কলমেই তাকে ফিট করেছে, শরীরে নয়। ফলে ২০ মিনিটের মাথাতেই তাকে বেরিয়ে আসতে হয় মাঠ থেকে। এরপর মাদ্রিদে না ফিরে তিনি সরাসরি যান নিজের পছন্দের চিকিৎসকের কাছে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আর কখনও হাঁটুর চোটে পরেননি তিনি। সেই পুরো সময়টা রিয়াল মাদ্রিদের মেডিক্যাল বোর্ডের কোনো পরামর্শই কানে নেননি তিনি। সেখান থেকেই দুই দলের দ্বন্দ্বের শুরু।

এমনকি ২০১৪ বিশ্বকাপের আগেও যখন বিশ্বকাপ খেলতে বারবার মানা করেছিল স্যানিতাস এফসি, তিনি কোনো কথা না শুনেই চলে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপ খেলতে। এমনকি ২০১৫-১৬ মৌসুমেও সেভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে হাঁটুর চোটে মাঠ থেকে উঠে যান তিনি। কিন্তু এরপরই খবর পাওয়া গেল, চোট সারাতে রিয়াল মাদ্রিদ মেডিক্যাল টিমের শরণাপন্ন হননি তিনি। বরং নিজে যোগাযোগ করে গিয়েছেন নিজস্ব ফিজিও থেরাপিস্টের কাছে। সেই আগের থেরাপিস্টের কাছে, কারণ আগে থেকেই এদের উপর বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল তাঁর।

রোনালদো তো শুরু মাত্র। স্যানিটাসের উপর ভরসা হারানো খেলোয়াড়দের মধ্যে রয়েছেন পেপে, হিগুয়েইন, রুড ভ্যান নিস্টেলরয়ের মতন খেলোয়াড়। চোটে পরলে রিয়াল মাদ্রিদের মেডিক্যাল টিমের পরামর্শ না নিয়ে নিজেরাই চিকিৎসার জন্য পছন্দের ডাক্তারের কাছে ছুটতেন। গঞ্জালো হিগুয়েন তো বারবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন দলের মেডিক্যাল স্টাফদের উপর।

তাঁর মতো প্রোফাইলিক গোলস্কোরারের সম্ভাবনাও কুঁড়িতেই নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা জেগেছিল। ২০১১ সালে হার্নিয়া ইনজুরির কারণে যখন মাঠের বাইরে চলে যেতে হয়ে রিয়াল সুপারস্টারকে, তখন মেডিকুয়াল বোর্ড তাকে পরামর্শ দিয়েছিল কিছুদিন রেস্ট নিতে। তাদের মতে রেস্ট নিলেই আবার মাঠে ফিরতে পারবেন তিনি। কোনো অপারেশনের দরকার নেই। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পরেও দেখা গেল কোনো লাভই হয়নি।

এরপর নিজ উদ্দোগে শিকাগো গিয়ে দেখেন তার অবস্থা খুবই খারাপ, ইমিডিয়েট চোট সারাতে ছুরি-কাঁচির নিচে না ঢুকলে শেষ হয়ে যেতে পারে ক্যারিয়ার। ফলাফলে ৬ মাস মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছিল তাকে। এমনকি সে সময়ের কোচ জোসে মোরিনহো পর্যন্ত ক্ষিপ্ত ছিলেন এতোদিন মাঠের বাইরে থাকার জন্য। মেডিক্যাল টিমের উপরেও। বলতে গেলে ঐ ৬ মাসেই রিয়াল মাদ্রিদে নিজের জায়গা হারান করিম বেনজেমার কাছে।

এতো গেল ফিট খেলোয়াড়দের কথা, ইঞ্জুরি প্রোন খেলোয়াড়েরা তো রিয়ালে টিকতেই পারে না। বিশ্বকাপে চোট নিয়ে খেলার পর ফিরে এসে কাকার প্রয়োজন ছিল ট্রিটমেন্টের। কিন্তু স্যানিতাসের পূনর্বাসন ট্যাক্টিসের ফলাফল হিসেবে সেই ফর্মই খুঁজে পেলেন না আর কাকা। এসি মিলানের কাকা আর ফিরতে পারেননি সেই সৌন্দর্য্যে। মোরিনহোর আমলের সাইনিং নুরি সাহিনও রিয়াল ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ইনজুরিতে। লুকাস সিলভার হার্টের সমস্যা ধরতেও বেশ দেরি করে ফেলেছিল তারা। যদিও সেখানে তাদের দোষ দেওয়া যায় না, কারণ অ্যানুয়াল চেক-আপ একবারই হয় প্রতি দলে আর সেখানেই তার সমস্যা ধরা পরেছিল। বলতে গেলে ক্যারিয়ার একরকম শেষই হয়ে গিয়েছে তাঁঁর।

বর্তমান দলের দিকে তাকালে সমস্যাটা আরো স্পষ্ট। বলা বাহুল্য রিয়ালের সেই দল আর আগের মতন নেই। মধ্যবয়সী তারকার থেকে রিয়ালে এখন সুপারস্টার আর ইয়াংস্টার দিয়ে ভরপুর। সেখানেই দেখুন চোটজর্জর খেলোয়াড়ের তালিকাটা। দানি কার্ভাহাল, মার্কো অ্যাসেন্সিও, রদ্রিগো, ওডেগার্ড; কেউই ক্যারিয়ারের শুরুটা ইনজুরিপ্রোন হিসেবে হয়নি। কিন্তু রিয়ালে ক্যারিয়ার শুরু হতে না হতেই তারা হয়ে গিয়েছে ইনজুরিপ্রোন!

এমনকি গ্যারেথ বেলও রিয়ালের আসার আগে হাতে গুনে চোটে পরেছেন হাতে গুনে ৪ বার। আর রিয়ালে আসার পর তো রিয়াল সমর্থকেরা গুনতে গুনতে হাতের কর শেষ করে ফেলেছেন। চোট আর তার পিছু ছাড়েনা। একই ঘটনা আবারও রিপিট হচ্ছে ইডেন হ্যাজার্ডের সাথে। তারও দোষ যৎসামান্য আছে বৈকি, কিন্তু তাই বলে দিনের পর দিন মাঠের বাইরে বসে থাকার দোষ মেডিক্যাল টিমের উপরেই বর্তায়। এমনকি রিয়ালের চার অধিনায়কের প্রত্যেকের সাথেই বিবাদে জড়িয়েছে স্যানিতাস।

এমন না যে স্যানিতাসের উপর বিরক্ত হননি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। ২০১৩ সালে এসে দলের প্রধান শল্যবিদ হিসাবে নিয়োগ দেন ডাঃ হেসুস অলমোকে। যদিও মূল চিকিৎসক ও স্যানিতাসের মধ্যে সমস্যা অনেকবারই মিডিয়ার সামনে এসেছে। এরপর ২০১৭ সালে অলমো রিয়াল ছেড়ে চলে গেলে আবার একচ্ছত্রভাবে চিকিৎসার দায়িত্বে ফেরত আসে স্যানিতাস।

একজন খেলোয়াড়ের ফিটনেসের অনেক বড় একটা অংশ নির্ভর করে নিজের উপর। নিজের শরীরকে ফিট রাখাও তাদের বড় একটি কাজের মধ্যে পরে। কিন্তু একটি দলে যখন ইঞ্জুরির কারণে খেলানোর মতন পর্যাপ্ত খেলোয়াড় থাকে না, তখন সেই দায় মেডিক্যাল টিমের উপরেও বর্তায়। রিয়ালের সাথে স্যানিতাসের প্রায় ১৫ বছরের সম্পর্ক শেষ হতে চলেছে এ বছরের জুনে। মাদ্রিদভিত্তিক এই আকাশী নীল মেডিক্যাল কোম্পানি রিয়ালের দুঃখ হয়ে আরো থাকবেন কীনা, সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে একমাত্র সময়ই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link