কবি, কাব্য ও মুগ্ধতা

১৯৩৯, ওয়ারশ। ধ্বংসস্তূপের মাঝে একটি ভদ্রলোক ঠায় বসে পিয়ানো বাজাচ্ছেন ততক্ষণ, যতক্ষণ না বোমটা সোজা দেওয়ালে এসে পড়ছে। ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ শুরুই হয় এইভাবে।

নাৎসি জার্মান রোগে আক্রান্ত পোল্যাণ্ডে তাকালে তখন শুধু বারুদের ধোঁয়া, কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠা বিষাক্ত গ্যাসে ছয়লাপ। এমতাবস্থায়, স্প্লিজ্টম্যান বসে একমনে বাজাচ্ছেন পিয়ানো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার সে শৈল্পিক রূপ পাল্টাচ্ছে না।

ঘরহারা, পরিবার-হারা, ভীত, সন্ত্রস্ত সেই পিয়ানোবাদকের কপালে জুটছে না খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থান। চারিদিকে চেয়ে চেয়ে শুধু দেখছেন সাধের শহর ওয়ারশ ভেঙে পড়ছে যুদ্ধের দামামাবাজে, নিশ্চুপ , নিষ্প্রাণ, নিস্পন্দদের মাঝে একা হেঁটে চলেছেন ব্যস্ত শিল্পী। শেষ হয়েও যার সবটুকু শেষ হয়নি।

পড়ন্ত সূর্যের আলোয় বসে যারা কবিতা লেখে, তাদের জীবনের ব্যালেন্স শিটে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যায় দু:খের অঙ্কগুলো – যার একটাও মেলেনি, কখনও মিলবে না। সমীকরণের দল আকুল হয়ে বসে থাকে পথপানে চেয়ে, পথের শেষে দাঁত-জিভ বের করা রাক্ষসকরা খুবলে খাবে জেনেও।

রোনালদিনহো যখন ফুটবল খেলা শুরু করেছিলেন, আশেপাশের তারকাদের সমাবেশে ব্রাজিলের ফুটবল নক্ষত্রখচিত। রিভালদো, রোনালদো লিমা, জুনিনহো, রবার্তো কার্লোস, তাফারেল – নামের ওজন এত ভারি এবং তাতেই বাস রিও থেকে কলকাতা বা ঢাকা – পরপর দু’বার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছে তারা। কোপা চ্যাম্পিয়ন।

এতদ্বারা বিশ্ববাসীকে রীতিমত শাসন করছে যখন, সেই ভরা সোনালি সময়ে রোনালদিনহোর ফুটবল মঞ্চে আগমন। তারপর ইতিহাস বয়েছে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে। রোনালদিনহো ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে গোল করেছেন। বাংলায় কেউ লিখেছেন তখন, ‘তুমি আমায় ঝর্ণা শেখবার যে বইটা দিয়েছিলে, আজ সেখানে মস্ত এক জলপ্রপাত লাফিয়ে পড়ছে সারাদিন…’

জয় গোস্বামী রোনালদিনহোর কেউ হন কি?

সেই কবে কোন চায়ের দোকানে এক অনামী অতিথির গলায় শুনেছিলাম সে অমোঘ বাণী – সবসময় কালি, কলম, মন দিয়েই কবিতা লেখা হয়, এ ধারণা সঠিক নয়। হাত ব্যতিরেকে শরীরের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে যারা কবিতা লিখতে জানে, কষ্টের যাপনে সঙ্গী হতে জানে।

৫০-৫০ এরিয়াল বলকে ডান পায়ে রিসিভ করে প্রেশার করা তিনটে ডিফেন্ডারের মাঝখান দিয়ে যখন রোনাল্ডিনহো বেরিয়ে গেলেন টাচলাইনের ধার থেকে, এ কথার মর্ম ব্রেনে গেঁথেছিল সেই সময়। কাঁধে, মাথায়, এক হাত থেকে অন্য হাতে, ঊরুতে বল রেখে রোনালদিনহো বোঝাচ্ছেন সেই অনামী অতিথির কথাগুলো কতখানি সত্যি।

সেই শুরু। কিশোর সেই চোখে ততদিনে ধরা পড়ে গেছেন সামান্য দাঁত উঁচু, লম্বা চুলের রোনালদিনহো। বার্সেলোনাকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতাচ্ছেন যিনি। ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে থাকা অবস্থায় করেছেন নো-লুক পাস। অর্থাৎ না তাকিয়ে ঠিকঠাক জায়গায় বল ফেলার এক আশ্চর্য ধাঁধা!

মোহিত হচ্ছে বিশ্ববাসী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিন-চার জন ডিফেন্ডারকে কোনও আশ্চর্য জাদুকাঠির ছোঁয়ায় নিমেষে ভ্যানিশ করছেন। যেভাবে ঝোড়ো হাওয়ায় যাদবপুরের রাস্তায় কপালে পড়ে থাকা চুল সরিয়ে হাঁটে এক ললিতমুখের তরুণী। ঐ একই ধরণে, চলনে, মুগ্ধতার পরশ ছড়িয়ে যাচ্ছেন রোনালদিনহো, ব্রাজিলের ১০ নম্বর ঝাঁকড়া চুলের কবি।

আসলে প্রেমে পড়ার কোনও বয়স লাগে না। লাগে না মুহূর্ত, প্রয়োজন পড়ে না কারোর মুখাপেক্ষির। এমনিই হয়, চোখ যাকে টেনে নেয় আলাদা ভাবে। রোনালদিনহো, কাকা – কিশোর বয়সের চঞ্চল মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে যায় কোনও কোনও ভাস্কর্য। ঐ যাদবপুরের মেয়েটির মত। কখনও সে আসে কানের লম্বা দুলে, কখনও সাজের আড়ম্বর বলতে ছোট্ট একটা লাল টিপই সম্বল। তবু মুগ্ধতার কোনও শেষ নেই। মুগ্ধতার কোনও শেষ হয় না।

২৭শে জুলাই, ২০১১। কিছু বছর পরে ব্রাজিল আবার পাবে তাদের নতুন সুপারস্টারকে। তখন উঠতি তারকার সামনে শেষবার দেখা দিয়েছিলেন ঐ হেয়ারব্যান্ড পরা ঝাঁকড়া চুলের ভাবুক। বুঝিয়ে গেছিলেন, কেন তিনিই – কেন, তিনিই।

নেইমারের স্যান্তোসের মুখোমুখি রোনালদিনহোর ফ্ল্যামেঙ্গো। স্যান্টোসের ঘরের মাঠে খেলা এবং টিম হিসেবে ফ্ল্যামেঙ্গোর চেয়ে বেটার। সেই স্যান্টোস, যাদের ঘরের ছেলে পেলে। নেইমার তখন সবে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। সে দ্যুতির জৌলুসে প্রথমেই ২-০ তে এগিয়ে গেল স্যান্টোস। রোনাল্ডিনহোর প্রথম গোলের সৌজন্যে প্রথমার্ধে খেলা ৩-১। দ্বিতীয়ার্ধে স্যান্টোস আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল বুড়ো কবির চরণে।

সেই খেলায়, যতটুকু বাকি থাকা অবশেষ, রোনালদিনহো করেছিলেন হ্যাটট্রিক। ৫-৪ এ ম্যাচ জিতেছিল ফ্ল্যামেঙ্গো। স্তব্ধ, মুগ্ধ নেইমার এর অনেক বছর যখন বার্সেলোনায় পাড়ি দিলেন, তখন শুধু বলেছিলেন, ‘No one can compare to Ronaldinho. I remember his plays, his dribbles. I remember him winning every title at the Camp Nou…’

শেষ কথাগুলোও ধার নিই তবে এখন, ‘শেষ জীবনের রাঙা হয়ে যাওয়া আলো, এখানে সঙ্গে করে এনেছে আমাকে… ’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link