সাতক্ষীরার ডান হাতি মুস্তাফিজ

মুস্তাফিজের ভাইয়ের একটা বাইক ছিল। সেই বাইকের পিছনে বসে রোজ ৪০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সাতক্ষীরায় অনুশীলন করতে যেতেন পেসার মুস্তাফিজুর রহমান। কেননা মুস্তাফিজদের গ্রামে ক্রিকেট খেলার কোন ব্যবস্থা ছিল না। সেজন্যই এতটা পথ পারি দিয়ে রোজ শহরে আসতে হতো। মুস্তাফিজের এই গল্প তো অনেকেই জানেন। তবে অজানা একটি গল্পও আছে, মুস্তাফিজদের পাশের গ্রাম থেকেই উঠে এসেছেন ডানহাতি পেসার সালমান হোসেনও।

মুস্তাফিজের তো তবু ভাইয়ের বাইক ছিল, সালমান সেটুকুও পাননি। ফলে প্রতিদিন ১৫ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে, এরপর আবার বাসের ছাদে করে ক্রিকেট খেলতে যেতেন সাতক্ষীরা শহরে। মুস্তাফিজ কিংবা সালমানরা এতটাই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসেছেন যে সেখানে রোদে কেউ ক্রিকেট খেললে তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি হয়। সালমানের কোচ তাই বলছিলেন ওরা যেখান থেকে এসেছে সেখানে ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন দেখাও পাপ।

তবুও সালমান, মুস্তাফিজরা স্বপ্ন দেখেন বলেই বাংলাদেশের ক্রিকেট বেঁচে থাকে। মুস্তাফিজের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, তবে সালমান এখনো নিজের স্বপ্নটা নিয়ে লড়াই করছেন। প্রথম বিভাগের ক্রিকেটেও নিজের নাম লিখিয়ে ফেলেছেন। অথচ প্রথম যখন ঢাকায় আসেন তখন এক জোড়া জুতাও ছিলনা। মুস্তাফিজের কাছ থেকে চেয়েই পুরনো জুতা নিয়ে এসেছিলেন। তবুও এই ঢাকা কেন্দ্রীক ক্রিকেট ব্যবস্থায় সালমানদের ঠাই পাওয়া কঠিন।

মৌসুমের সময় যখন ঢাকায় ক্রিকেট খেলতে আসেন তখন ঢাকায় থাকার জায়গা নেই। এবারো যেমন মৌসুম শুরু হবার আগেই চলে এসেছেন নিজেকে তৈরি করার জন্য। নিজেও জানেননা পরের বেলায় কী খাবেন। এমনকি এখনো থাকার একটা জায়গা পাননি। একটা দোকানের মেঝেতে রাতে কোনরকমে একটা কিছু পেতে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে উঠে আবার বল হাতে ছুটতে হবে যে, অনেক জোরে বল করতে হবে তো।

অথচ সারাদিনে খাবারের ঠিক নেই। সকালে খেলে দুপুরে খেতে পারেননা, দুপুরে খেলে আবার রাতের খাবার জোগার করা কঠিন। তবুও সালমান এক বুক স্বপ্ন নিয়ে প্রতিবছর ঢাকায় আসেন। বড় পেসার হতে হবে তাঁকে। টেস্ট ক্রিকেট খেলবেন বলে ঘর ছেড়েছেন তিনি। পড়াশোনাও ছেড়েছেন।

সালমান বলছিলেন, ‘আমার একটা স্বপ্ন ক্রিকেটার হওয়া, পেসার হওয়া। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম, তাও করতে পারিনি ক্রিকেটের জন্য। জেলা দল, বিভাগীয় দল হয়ে এখন প্রথম বিভাগের ক্রিকেট পর্যন্ত এসেছি। কিন্তু এই লেভেলে টিকে থাকতে হলে ভালো ট্রেইনার লাগে, কোচ লাগে। ঢাকা শহরে সারাবছর থাকতে হলে টাকা প্রয়োজন। আমার পক্ষে তো এসব সম্ভব না। আমার বাসার থেকে আজ পর্যন্ত একজোড়া জুতাও আমি পাইনি। মুস্তাফিজ ভাইয়ের জুতা পরেই আমি বোলিং করি। ভাই আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আমি জোরে বল করতে পারি, টানা বল করে যেতে পারি। একদিন বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলাই আমার স্বপ্ন।’

সালমান ঢাকায় প্রথম এসেছিলেন কোচ সাদিকুজ্জামান পিন্টুর কাছে। রূপগঞ্জ টাইগার্সের সহকারী কোচ তিনি। সালমানের পেস দেখে প্রথম দিনই ভালো লেগেছিল তাঁর। এরপর গত ছয়-সাত বছর ধরে ছেলেটাকে আগলে রেখেছেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলার জন্য তৈরি করেছেন।

এই কোচ বলছিলেন, ‘প্রথম সালমান যখন ঢাকায় আসবে ওর কাছে ভাড়াটাও ছিল না। তবুও কীভাবে যেন এসেছিল। তখনই অনেক জোরে বল করতো, তবে অনেক কিছু নিয়ে কাজ করার ছিল। এখন তো সে বেশ ভালো করছে। এবার রূপগঞ্জ টাইগার্সের বড় বড় ক্রিকেটাররাও তাঁর বোলিং দেখে ভালো বলেছে। মাশরাফি বিন মর্তুজাও খুব খুশি হয়েছে ওকে (সালমান) দেখে। অথচ সালমান যেখান থেকে উঠে এসেছে, সেখানে বসে ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখাও পাপ। তবুও ক্রিকেটের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা ছিল বলেই এতদূর আসতে পেরেছে। যত্ন নিলে আরো অনেকদূর যাবে আমার বিশ্বাস।’

সালমানের মত এমন অনেক ক্রিকেটার মৌসুম শুরু হবার আগে ঢাকায় আসেন। নিজেদের তৈরি করার জন্য। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো থেকে ক্রিকেট খেলতে আসা এই ছেলেগুলোর দিকে কী আদৌ কেউ নজর দেয়। একটা থাকার জায়গা আর তিনবেলার খাবার কী অনেক বেশি চাওয়া একজন ক্রিকেটারের জন্য? নাকি ঢাকা কেন্দ্রীক ক্রিকেট ব্যবস্থা সালমানদের কখনো আপন করে নিতেই চায়না?

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link