স্কট ‘দ্য রাস’

তাঁর টেস্ট অভিষেক হওয়ার কথা ছিল করাচিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে। তবে করাচিতে সেদিন বোম পড়ায় সেই ম্যাচটাই বাতিল হয়ে যায়। বুকের ভেতর জ্বলন্ত অগ্নিশিখা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি। সে বছরেরই মাঝামাঝি সময়ে ক্যারিবীয় দ্বীপে আরেকটি বোম পড়ে। বুকের ভিতর আঁটকে রাখা সেই জ্বলন্ত অগ্নিশিখার নাম নিউজিল্যান্ডের ‘দ্য রাস’, পুরো নাম স্কট বার্নার্ডো স্টাইরিস।

নিউজিল্যান্ডের সাবেক এই অলরাউন্ডারের জন্মস্থান মূলত অস্ট্রেলিয়ায়। তবে মাত্র ছয় বছর বয়সেই মায়ের হাত ধরে পাড়ি জমিয়েছিলেন হ্যামিলটন শহরে। ১৯৯৪ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই নর্দান ডিসট্রিকসের হয়ে নাম লিখিয়ে ফেললেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। সবাই বলাবলি করছিল খুব দ্রুতই জাতীয় দলে ডাক পাবেন স্কট। কেননা তাঁর বোলিংয়ে সেই সময় আগুন ঝড়তো, এছাড়া ব্যাটিংটাও একেবারে মন্দ না। দ্রুত রান তুলতে পারেন। ফলে এমন একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার বিশ্বের যেকোনো দলেই জায়গা করে নিবে।

তবে দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে গেলেও ডাক আসেনা স্কট বার্নার্ডোর। এর মধ্যে হাঁটুর ইনজুরিতে পড়ে মাঠের বাইরে ছিলেন অনেকদিন। ইনজুরি কাটিয়ে আবার মাঠে ফিরলেও আগের মত বোলিংয়ের ধারটা আর নেই। ফলে সবাই দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো আরেকটি প্রতিভা হারিয়ে যাওয়ার। তাঁরা তো আর জানতো না স্কট এক জ্বলন্ত অগ্নিশিখা।

বোলিং কমিয়ে এবার নিজের ব্যাটিং এই নজর দেন স্কট। টুকটাক ব্যাট করতে জানা স্কট এবার হয়ে উঠলেন পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান। এখনো মাঝেমাঝে বল হাতে নেন। ইনজুরি কাটিয়ে নিজের বলের ধারটাও ফিরে পাচ্ছেন। সেই সময়েই ২০০২ সালে পাকিস্তান সফরের জন্য টেস্ট দলে ডাক আসে স্কটের। তাঁকে টেস্ট ক্যাপ দেয়া হলেও বোমা হামলায় বাতিল হয়ে যাওয়া ম্যাচে আর মাঠে নামা হলো না তাঁর। তবে সেই বছরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আবার সুযোগটা এলো।

ইনজুরি ধাঁর কেড়ে নিলেও বোলিংটা যে তাঁর রক্তবিন্দুতে ছিল। অভিষেক টেস্টেই ক্যারিবীয় ব্যাটিং গ্রেট ব্রায়ান লারার উইকেট তুলে নেন স্কট। তবে টিকে থাকার জন্য হাতে তোলা ব্যাটটা দিয়েই গোটা বিশ্বকে জানান দিলেন তিনি হারিয়ে যাননি। অভিষেক টেস্টেই আট নম্বরে ব্যাট করতে নেমে খেললেন ১০৭ রানের ইনিংস। দ্বিতীয় ইনিংসেও তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ৬৯ রান। তাঁর ব্যাটে চড়েই সেই ম্যাচ ড্র করতে পেরেছিল কিউইরা।

ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেকও হয়েছিল স্বপ্নের মত। রাজকোটে প্রথমবার মাঠে নেমেই তুলে নিয়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকারের উইকেট। তবে ওয়ানডে ক্রিকেটে অলরাউন্ডার স্কটের সেরা রূপ দেখেছিল ২০০৭ বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপে ৮৩.১৬ গড়ে করেছিলেন ৪৯৯ রান। ওদিকে বল হাতেও নিয়েছিলেন ৯ টি উইকেট।

এর আগে ২০০৫ সালে রেকর্ড রান তাড়া করতে গিয়ে সেঞ্চুরি করেছিলেন এই ব্যাটসম্যান। অস্ট্রেলিয়ার দেয়া ৩৩২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ৯৬ বলে খেলেছিলেন ১০১ রানের ঐতিহাসিক ইনিংস। তাঁর এই সেঞ্চুরিতেই সেই সময়ের বিশ্বসেরা দল অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও এক ওয়ানডে ম্যাচে বল হাতে ৬ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে করেছিলেন ৬৩ রান।

তবুও ইনজুরিরর কারণে তাঁর বোলিং এর সেরাটা হয়তো কখনোই দেখেনি ক্রিকেটবিশ্ব। তবুও লড়ে গিয়েছেন । ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর আগে নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন ১৮৮ ওয়ানডে। সেখানে তাঁর ঝুলিতে আছে ৪৪৮৩ রান ও ১৩৭ উইকেট। এছাড়া ২৯ টেস্ট ম্যাচেও ১৫৮৬ রানের পাশাপাশি আছে ২০ টি উইকেট।

ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে টি-টোয়েন্টি ম্যাচও খেলেছেন ৩১ টি। সেখানে ৫৭৮ রানের সাথে আছে ১৮ উইকেট। সবমিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর ঝুলিতে আছে ৯ টি সেঞ্চুরি। ওয়ানডে ক্রিকেটে চার উইকেটও নিয়েছেন মোট চারবার।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর ২০১২ সালে একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে সাসেক্সের হয়ে ৩৮ বলে ঝড়ো এক সেঞ্চুরি করেছিলেন স্কট। সেই ইনিংসে এক ওভারে ৩৮ রান নেয়ার কীর্তিও করেছিলেন এই ব্যাটসম্যান। এছাড়া ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছেন কমেন্ট্রি বক্সে।

ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক নাসের হুসাইন বলেছিলেন স্কট স্টাইরিস ক্রিকেট মাঠের এক লড়াকু সৈনিক। সত্যিই তাই! ‘দ্য রাস’ ব্যাট হাতে লড়ে গেছেন তাঁর হাঁটুর ব্যাথাকে হার মানাবেন বলে, তিনি লড়ে গেছেন করাচির বোমা হামলার বিরুদ্ধে এখনো স্কট কমেন্ট্রি বক্সে লড়ে যাচ্ছেন ক্রিকেটের আওয়াজ গোটা দুনিয়ায় পৌছে দেয়ার জন্য। সৈনিকদের কাজই তো লড়াই করে যাওয়া।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link