১.
ইংল্যান্ডের পিচ। লেস্টারশায়ারের হয়ে ব্যাট করতে এলেন আট নম্বর ব্যাটসম্যান জেরেমি স্নেপ। বল হাতে আব্দুল রজ্জাক। পুরোনো বল হওয়ার দরুণ রিভার্স সুইং হওয়া স্বভাবসিদ্ধ। হাতে আরও চল্লিশ খানা ওভার, দিন শেষ হয়ে যাওয়ার পূর্বেই ইনিংস শেষ হয়ে যাওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল।
উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয় ছোকরার কাছে স্নেপ গিয়ে বললেন, ‘এই লোক আমাদের নিয়ে মজা করছে। আমি তো বলটা চোখেই দেখছি না। যা করার তোমাকেই করতে হবে!’
ভারতীয় ছোকরা নিজের ঠোঁট কামড়ালেন এবং বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি দেখছি।’
দু’পা পিছিয়ে স্টান্স নিলেন ভারতীয় ছোকরা এবং রাজ্জাকের পরবর্তী বল উড়ে গেল সোজা সীমানার বাইরে গ্যালারিতে। আম্পায়ারদ্বয় পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে নতুন বল আনার নির্দেশ দিলেন। ভারতীয় ছোকরার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো সেই উক্তি, ‘নতুন বল এখন আরো অনেকক্ষণের জন্য স্যুইং করবে না। আমরা ঘণ্টাদুয়েকের জন্য নিরাপদ।’
কে এই ভারতীয় ছোকরা ? উত্তরটা ক্রমশ প্রকাশ্য!
২.
বোলিংয়ে শোয়েব আখতার, মোহাম্মদ সামি কিংবা সাকলাইন মুশতাকের মতো তাবড়-তাবড়রা – ছক্কা হাঁকানো বড্ড কষ্টসাধ্য। শচীন টেন্ডুলকার এলেন এবং বললেন, ‘আর একটা ছক্কা মারলেই, তুমি মারা পড়বে।’ ৭৪ থেকে ২৯৫ রান পর্যন্ত বিনা ছক্কাতে কেটে গেল ইনিংস। এভাবে আর কতক্ষণ?
ব্রিটানিয়া ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাটসম্যান শচীনের দিকে ফিরে গিয়ে বলেছিলেন, সাকলাইন আসলেই একটা ছক্কা মারবেন। ক্রিকেট ঈশ্বরও যেন চেয়েছিলেন যে – সাকলাইন মুশতাকের পরের বলটি যেন সপাটে গ্যালারিতে আছড়ে পড়ে। ঠিক এই সন্ধিক্ষণে বোলিংয়ে এলেন সাকলাইন, বল আছড়ে পড়লো গ্যালারিতে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যাট তুললেন ‘মুলতানের সুলতান’। প্রথম ভারতীয় হিসেবে টেস্টে ৩০০ যে তিনিই করলেন। পরবর্তীতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি ঠিক করে ফেলি পরের বলটায় ছক্কা হবে তাহলে বাউন্ডারিতে ১০ জন ফিল্ডার রাখলেও নিশ্চিত যে – ছক্কা হবেই।’
এই স্পর্ধা, এই সোয়াগ, কণ্ঠে এই উদ্ধতা? ঠিক ধরেছেন, তিনিই শেবাগ, বীরেন্দ্র শেবাগ।
৩.
‘রাউন্ড দ্য উইকেটে আসো, আমি তোমার বলে ছক্কা হাঁকাবো’ – প্রেসক্রিপশন মতো প্রোটিয়া পল হ্যারিস রাউন্ড দ্য উইকেটে এলেন এবং বল পৌঁছে গেল সোজা সীমানার বাইরে। ব্যক্তিগত স্কোর ২৯৭ এর পা ছুলো।
৪.
স্কোর প্রায় ২০০ ছুঁই ছুঁই.। সাইমন ক্যাটিচের বাঁ- হাতি লেগ-স্পিন! বল উড়ে গেল হাওয়াতে! গোলাকার সীমানা পেরিয়ে যাবে?? নাহ্! তা আর পেরোনো হয়নি। ক্যাচ মিস করার মতো ভুল আর করেননি নাথান ব্র্যাকেন! ১৯৫ রানেই শেষ হলো মহাকাব্যিক ইনিংস! হার্শা ভোগলে ব্যক্ত করলেন, ‘মাত্র পাঁচ রানের জন্য তুমি ডাবল সেঞ্চুরি মিস করলে!’
সপাটে জবাব এলো, ‘আমি মাত্র তিন গজের জন্য ছক্কা মিস করলাম।’
৫.
ভিভের সাম্রাজ্যে হানা দিচ্ছে এক ভারতীয় ব্যাটসম্যান। নেহরাকে স্কুটিতে তুলে নিয়ে পাড়ি দিতেন ফিরোজ শাহ কোটলার উদ্দেশ্যে। চলমান ইতিহাস এবং রেকর্ড বুক। বোলারদের মগজে বর্শার মতো ঢুকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার নাম বীরেন্দ্র শেবাগ।
শচীন, দ্রাবিড়, লক্ষ্মণ যদি রক্ষক হয়ে থাকেন তবে সংহারক ছিলেন ‘নজফগড়ের নবাব’। পন্টিংয়ের স্লেজিং, লি’র বিদ্যুতের ঝলকানি সহিত লাল রঙের বল আছড়ে পড়ল অফস্টাম্পের বাইরে। কোনোও এক ঐশ্বরিক শক্তির দরুন রঙিন আভায় মোড়া স্কোয়্যার কাটে বল সহজেই পেরিয়ে যায় সীমানা। পেরিয়ে যায় বহু হার্ডল।
পঞ্চপাণ্ডবের এই ভীম যতক্ষণ পিচে রেওয়াজ করতেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের কোনোও এক গ্রামের জনগণ সমবেত হতো এক টিভির সামনে। ঈশ্বরের প্রতি ফুঁটে উঠত তাদের এক করুণ আর্জি! আজ যেন কোনোক্রমে শেবাগ ১০ ওভার টিকে যায়!
শুরুতে ব্যাটিং করতে নেমে প্রাণবন্ত করে তোলে দর্শকদের চিৎকারকে, সুধা ঢেলে দেয় ইনিংসে। গেইলের নামের সাথে টর্নেডো কিংবা হ্যারিকেন জড়িত থাকলেও এই ভারতীয় ব্যাটসম্যানের নাম আধুনিক যুগের ভিভ এবং ক্রিকেটের নবজাগরণের পথিকৃত হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১০০ টি বল খেলে গড়ে ৮২ খানা রান করে গিয়েছেন টেস্ট ক্রিকেটে। উৎরে গিয়েছেন মুম্বাই থেকে মেলবোর্ন, কলকাতা থেকে কার্ডিফ, জোহানেসবার্গ থেকে লর্ডস।
আজও সেই আপার কাট চোখের সামনে আবছা হয়ে ফিরে আসে, ফিরে আসে শেবাগের ব্যাটিং দেখার জন্য স্কুল ও টিউশন বাদ দেওয়ার স্মৃতি। গোলাপের কাঁটা থাকলেও তার সুবাস সর্বজনবিদিত। তেমনই শেবাগ নামের বুলেট থেকে হয়তো ভালোবাসার কুঁড়ি ফোটে তাঁর অবসরের পর থেকে। শচীন কিংবা বিরাটের মতো তাঁর ম্যাজেস্টি না থাকলেও তাঁর মধ্যে ছিল স্পর্ধা, ছিল সোয়াগ, আর হ্যাঁ এটাই শেবাগ।