মৌচাক – শহীদ আফ্রিদি

ওয়ানডেতে ৮০০০+ রান, ৩৯৫ উইকেট, ৩২ বার ম্যান অফ দ্য ম্যাচ, ৩৫১ ছক্কা, ২০ বলের কমে ৬ বার ৫০ বা তার বেশি রান, ওয়ানডে ইতিহাসে সাতটি দ্রুততম সেঞ্চুরির মধ্যে দু’টির অধিকারী (৩৭ আর ৪৫বল), ক্যারিয়ার স্ট্রাইকরেট ১১৭, টি-টোয়েন্টিতে ১১ বার ম্যান অব দ্য ম্যাচ, প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট, পরের আসরে ফাইনালে ম্যান অব দ্য ম্যাচ, ৫টি টেস্ট সেঞ্চুরি।

এই পরিসংখ্যানগুলো বিবেচনায় নিলে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তাকে একজন অসাধারণ অলরাউন্ডার ক্রিকেটার মানা উচিত, কিন্তু যখন আপনি জানবেন পরিসংখ্যান ওয়ালা ক্রিকেটারটির নাম শহীদ আফ্রিদি, আপনি কেবল একটি পরিসংখ্যান দিয়েই আলোচনার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে পারবেন; ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৩০ বার ডাক মেরেছেন (সর্বোচ্চ ৩৪ বার জয়াসুরিয়া), এবং টেস্ট, টি-টোয়েন্টি, টি-টেন ফরম্যাটে পাওয়া আরও কিছু ডাকসূত্রে বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্রিকেটপ্রেমীর কাছে তার পরিচিতি ‘ডাকবাবা’ বা ‘ডাক্রিদি’ হিসেবে।

অপরপক্ষে, আরেক শ্রেণির ক্রিকেট দর্শক আছে যারা আফ্রিদিকে চেনে ‘বুমবুম’ নিক নেমে, যে মাঠে নেমে চার-ছক্কা হাঁকাবে; তাকে মনে করে ক্রিস গেইল, শেবাগ বা জয়াসুরিয়ার মতো ন্যাচারাল স্ট্রোক প্লেয়ার, যে ম্যাচ জিতিয়ে আনবে।

তাদের এই প্রত্যাশায় বিরক্ত হয়ে ডাক্রিদি ডাকা গোষ্ঠী তার ক্রিকেটীয় যোগ্যতাকে খেলো গণ্য করে একজন কমেডিয়ান হিসেবে চিন্তা করে। সুতরাং ফ্যান এবং উন্নাসিক কোনো পক্ষের কাছ থেকেই ক্রিকেটার হিসেবে আফ্রিদির নির্মোহ মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

অনলাইনে আফ্রিদিকে নিয়ে লেখার গোলযোগ দুটি।

প্রথমত, ফেসবুক পুলিশ। যেহেতু আফ্রিদি পাকিস্তানের ক্রিকেটার, সুতরাং তাকে নিয়ে লেখা মানেই লেখক পাকিপ্রেমী। এবং ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তুলে এনে লেখকের বংশোদ্ধার করা হবে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে তবে ক্রিকেটীয় সম্পর্ক কেন বজায় রাখে, এবং পাকিস্তানের ম্যাচ কেন সম্প্রচার করে এই কাউন্টার প্রশ্নে ফেসবুক পুলিশ লিবারেল বা যুক্তিবাদী হয়ে কখনো আইসিসির নিয়ম, কখনো বা গ্লোবালাইজেশন নীতি সামনে নিয়ে আসে।

দ্বিতীয়ত, ধৈর্যহীন মানুষ। এরা কোনো লেখা সম্পূর্ণ পড়ে না। কিছু বিচ্ছিন্ন লাইন এবং কী-ওয়ার্ড দেখে পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নেয়, তারপর ক্রমাগত মন্তব্য লিখতে থাকে। ক্রিটিকালি কোনো কিছুকে দেখবার বা বিচার করবার ক্ষেত্রে যতটুকু চিন্তা আর পর্যবেক্ষণ শক্তির প্রয়োজন হয়, অধিকাংশ ক্রিকেটপ্রেমীর মধ্যেই তার নিদারুণ ঘাটতি।

ফলে, শহীদ আফ্রিদি নামটা বাংলাদেশের ক্রিকেট মহলে এক ট্যাবুর মত। আমি যেহেতু কোনো কোরাম বা গোষ্ঠী মেইনটেইন করে চলি না, নিজের বিশ্বাসকে গভীরভাবে ধারণ ও সঞ্চালন করি, ফলত আপাত অজনপ্রিয় বিষয়বস্তুকে ক্রিটিকালি বিশ্লেষণের মধ্যে অপার আনন্দ পাই।

শহীদ আফ্রিদি ট্যাবু হলেও আমার বিবেচনায় সে এক মৌচাক।

রশিদ খানের বয়স নিয়ে এখন যে রকম হাসাহাসি হয়, সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই মানুষ তাতে শামিল হয়। আজ থেকে ২৩-২৪ বছর আগে অনলাইন মিডিয়ার অস্তিত্ব ছিল না, তবুও পেপার-পত্রিকা বা সামাজিক আড্ডায় খেলোয়াড়দের বয়স নিয়ে সে সময়েও হাসাহাসি হয়েছে, যার মূল চরিত্র ছিল আফ্রিদি। সে যখন পাকিস্তানের হয়ে খেলা শুরু করে টিভিতে তার বয়স দেখাতো ১৭, এবং তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তখনই প্রশ্ন ছিল মানুষের মনে। আফ্রিদির বয়স ১৭, এটা ছিল আমাদের শৈশবের অন্যতম আলোচিত জোকস। রশিদ খান বোলার হিসেবে সাফল্য পেলেও গড় বাঙালি যেমন তার বয়সের বাইরে দৃষ্টি দিতে পারে না, আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগেও গড় বাঙালির মানসিকতা ভিন্ন ছিল না তেমন।

আর্জেন্টাইন ফুটবলার লিওনেল মেসির অবসর নিয়ে ব্রাজিলিয়ান সমর্থকেরা পিঞ্চ করে। ক্রিকেটেও অতীতে বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার অবসর ভেঙ্গে খেলায় ফিরেছে। তবে অবসর সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গুলোকে নাটকীয় করার ক্ষেত্রে পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের, এবং অবসরকে কমেডিতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে আফ্রিদি নিজেকে কিংবদন্তীর স্থানে নিয়ে গিয়েছেন। ‘how many times Shahid Afridi has retired’ এই লাইনটা লিখে গুগলে কত মানুষ সার্চ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। (অবসর সংক্রান্ত এই নাটকীয়তাকে অবশ্য ভিন্ন এক পারসপেক্টিভে দেখি আমি। লেখার পরবর্তী অংশে তা লিখবো)

বল টেম্পারিংয়ের দায়ে বেশ কয়েকবারই শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। তবু সংশোধন করেননি নিজেকে।

পাকিস্তান ক্রিকেটের সবচাইতে ইউনিক কমেডি হল অধিনায়কত্ব পজিশন। একটা সময় ছিল যখন একাদশের ৬-৭ জন খেলোয়াড়ই সাবেক অধিনায়ক। আফ্রিদি অধিনায়কত্ব পেয়েছে, পদচ্যুত হয়েছে, পুনরায় বহাল হয়েছে। কোচ-অধিনায়ক ব্যক্তিত্বের সংঘাত পাকিস্তানের আরেক ঐতিহ্য। এক্ষেত্রেও আফ্রিদি একজন কিংবদন্তী।

গৌতম গম্ভীরের সাথে তার বিরোধ ক্লাসিকাল পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। মাঠের মধ্যে মেজাজ হারানোর বা প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের সাথে বিরোধে জড়ানোর অসংখ্য দৃষ্টান্ত তার ক্যারিয়ার জুড়েই পাওয়া যাবে।।

উপরোল্লিখিত পয়েন্টগুলোই আফ্রিদির সমালোচিত হওয়ার ক্ষেত্রে ঘুরেফিরে আসবে। তবে আমার পর্যবেক্ষণ অনুসারে, এগুলো সাপোর্টিভ কারণ হতে পারে, মূল কারণটা রাজনৈতিক এবং তার উৎস আবিষ্কার করতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ভারত বনাম পাকিস্তানের বেস্ট অব থ্রি ফাইনালের প্রথম বা দ্বিতীয় ম্যাচে।

কী ঘটেছিল?

১৯৯৮ এর জানুয়ারিতে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশকে নিয়ে আয়োজিত হয়েছিল ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ। বাংলাদেশে ক্রিকেটের তখনকার যা মান তাতে অংশগ্রহণই ছিল মূখ্য। টুর্নামেন্টে ফাইনাল ছিল ৩ ম্যাচের। মূলত ভারত-পাকিস্তান ম্যাচসংখ্যা বাড়ানোই ছিল উদ্দেশ্য। যথারীতি দুই দলের মধ্যেই ফাইনাল হয়েছিল।

আফ্রিদি সে সময় সাঈদ আনোয়ারের সাথে ওপেন করতো। প্রথম বা দ্বিতীয় ফাইনালে আফ্রিদি একটি বাউন্ডারি হাঁকানোর পরে ক্যামেরা চলে যায় গ্যালারিতে উল্লসিত দর্শকদের মাঝখানে, সেখানে এক বাংলাদেশি তরুণী প্ল্যাকার্ডে লিখে এনেছে – ‘ম্যারি মি আফ্রিদি’!

বাংলাদেশের তরুণী বেহায়ার মতো বিয়ের আহবান জানাবে পাকিস্তানের তরুণ ক্রিকেটারকে, এবং সেটা টেলিভিশনের সৌজন্যে তিন দেশের মানুষের চোখে চলে গেল – এই অবমাননা রাখি কোথায়, মূলত এটাই ছিল আফ্রিদি ট্যাবুর প্রথম ধাপ।

আমরা যদি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা সাময়িক বিস্মৃত হই, এবং একই তরুণী একই প্ল্যাকার্ড নিয়ে মাঠে এসেছে, কেবল আফ্রিদির জায়গায় শচীন বা আজহার এর নাম লেখা, নিশ্চিতভাবেই সেটাকে ওই তরুণীর নিছক নির্বুদ্ধিতা হিসেবেই দেখা হত, এর বেশি কিছু নয়।

কিন্তু আফ্রিদি একজন পাকিস্তানী, যাদের সাথে লক্ষ প্রাণের রক্তের কলঙ্কিত ইতিহাস, একজন বাঙালি মেয়ে কেন হ্যাংলার মতো তাকেই পছন্দ করবে; হ্যাংলামিই যদি করবি বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারকে নিয়ে কর!

তখন ফেসবুক না থাকায় সেই তরুণীর পরবর্তী গতি কী হয়েছিল জানা যায়নি আর। তবে সেই ঘটনার বেশ কয়েক বছরে বাংলাদেশে ‘মেহেরজান’ নামে এক সিনেমা নির্মিত হয়েছিল, ভারতের জয়া বচ্চন-ভিক্টর ব্যানার্জি অভিনয় করেছিল, এবং সিনেমার ন্যারেটিভ আর ডিসকোর্স এতটাই ‘ম্যারি মি আফ্রিদি’ ঘরানার ছিল যে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সিনেমার প্রদর্শনী বন্ধ করতে বাধ্য হয় পরিচালক-প্রযোজক।

আমার বেড়ে ওঠা মাতৃতান্ত্রিক পরিবেশে। যে মহল্লায় থাকতাম সেখানে সমবয়সী ছেলের চাইতে মেয়ের সংখ্যা বেশি, পাশাপাশি নিজের বড় দুই বোন থাকায় শৈশব-কৈশোরে টিনএজ মেয়েদের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যার চিন্তা-ভাবনার সাথে পরিচয় ঘটেছিল।

তো সেইসব আপু নাটক বা সিনেমাতে যতটা আগ্রহী ছিলেন, ক্রিকেটে আগ্রহ একেবারেই কম। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা আর পাকিস্তানের খেলা তারা মিস করতেন না। কারণ সাউথ আফ্রিকার জন্টি রোডস, অ্যালান ডোনাল্ড, পাকিস্তানের আকিব জাভেদ, আমির সোহেল, শহিদ আফ্রিদি ছিল সুদর্শন!

ম্যারি মি আফ্রিদি – কে সেই চিন্তাধারার সাহসী বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখি এখন; তখন বয়স নিতান্তই কম থাকায় এতটা ক্রিটিকালি চিন্তা করতে পারিনি।

সেই ম্যাচের কিছুদিন পরে পাকিস্তান আবারও খেলতে এসেছিল বাংলাদেশে। ক্রীড়ালোক বা কোনো এক পত্রিকায় আফ্রিদির এক ইন্টারভিউ প্রকাশিত হয়েছিল, তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল – ‘বাংলাদেশে তো আপনার অনেক নারী ভক্ত, এ ব্যাপারে আপনার অনুভূতি কী? (পুরোপুরি স্মৃতিনির্ভরতায় লিখছি, প্রশ্নের বাক্য এদিক-সেদিক হতে পারে) আফ্রিদি এক কথায় উত্তর দেয়- ‘তারা ভয়ংকর’, এরপর নিজের ঘাড়ের পেছন দিকটা দেখায়, লিফটে এক নারীর সাথে দেখা হওয়ায় সে নাকি এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে।

আফ্রিদির জনপ্রিয়তার প্রাথমিক ভিত্তি পুরোটাই সৌন্দর্যনির্ভর। সে ব্যাটসম্যান নাকি বোলার এটা বিবেচ্যই নয়, সে একজন অত্যন্ত সুদর্শন ক্রিকেটার – এই অতি তুচ্ছ প্যারামিটারটাই বাংলাদেশে আফ্রিদি ক্রেজ এর জন্ম সনদ। যেহেতু সেই সকল তরুণী পরবর্তীতে মা হয়েছে, তাদের সন্তানদের মধ্যেও আফ্রিদি ফ্যান্টাসি কিছুটা হলেও সঞ্চারিত হয়েছে, তাদের ছোট ভাই-বোনের মধ্যে প্রভাব পড়েছে, পরিণত বয়সে এসেও তারা আর লজিক্যালি আফ্রিদিকে বিশ্লেষণ করতে পারেনি।

অন্যদিকে, সে সময় আফ্রিদি ফ্যাসিনেশনকে যারা হ্যাংলামি মনে করতো, তাদের বয়স বেড়েছে, কিন্তু নিজেদের পরিমণ্ডলে আফ্রিদি ইস্যুটাকে কৌতুক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছে। এটা চলেছে প্রজন্ম পরম্পরায়।

ফলে বাংলাদেশে আফ্রিদি কোন ক্রিকেটার না হয়ে সামাজিক ক্যারেক্টার হিসেবে বেশি আলোচিত অথবা সমালোচিত হয়েছে।

ক্রিকেটার সত্তায় নজর দেয়া হোক তবে।

আফ্রিদি একজন আদ্যন্ত বোলার। লেগ স্পিনার মুশতাক আহমেদের ইনজুরিতে সে দলে ঢুকেছিল। তবে মুশতাক যেখানে প্রথাগত লেগ স্পিনার, আফ্রিদি অনেকটাই আন-অর্থোডক্স, তার কুইকার ডেলিভারিগুলো গতিতে অনেক সময় ভেংকটেস প্রসাদের মতো জেনুইন পেসারদের বলের গতিকে ছাড়িয়ে যেত, সে কখনোই বিগ টার্নার ছিল না; লেগ স্পিনারের ভাণ্ডারে যেসব অস্ত্র ছিল সেগুলোর বেশিরভাগই তার বোলিংয়ে অনুপস্থিত। তবু উইকেট টেকিং সামর্থ্যের কারণে সে দলে ঢোকে।

ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা ঘটে তখনই। বোলিং তাঁর মূল কাজ হলেও কাজ চালানোর মত ব্যাটিং দক্ষতা ছিল, রিস্টে অত্যধিক জোর থাকায় পিঞ্চ হিটার হিসেবে তাকে ভাবা হতে থাকে এবং এক ম্যাচে ৩ নম্বরে নামিয়েও দেয়া হয়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সে ম্যাচে মাত্র ৩৭ বলে সেঞ্চুরি করে রেকর্ড গড়ে ফেলে, সে হয়ে ওঠে বিনোদনদায়ী ব্যাটসম্যান।

এবং মজার ব্যাপার হল, সে সময় ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার, আকিব জাভেদ, আতাউর রহমান, সাকলাইন মুশতাকের মত বোলার, সাথে আজহার মেহমুদ, আব্দুল রাজ্জাকের মত জেনুইন অলরাউন্ডার থাকায় আফ্রিদির বোলিং খুব বেশি প্রয়োজনও হত না, এরকম অনেক ম্যাচই গিয়েছে যেখানে সে ২-৩ ওভারের বেশি বোলিং পায়নি, বরং ফিল্ডিংয়ের জন্য কুখ্যাত পাকিস্তান টিমে সে হয়ে ওঠে অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠ ফিল্ডার। কালক্রমে লেগস্পিনার আফ্রিদি বিস্মৃত হয়ে বিধ্বংসী ওপেনার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, টেস্টেও জায়গা পায় ওপেনার হিসেবে, সেঞ্চুরি আদায় করে নেয়।

কিন্তু, তার ব্যাটিং কৌশল স্লগারদের মত, যেদিন ব্যাটে-বলে টাইমিং হয় রান আসে, বাকি দিনগুলোতে দৃষ্টিকটুভাবে আউট হয়। এরকম প্লেয়ারের পক্ষে টপ অর্ডারে রান পাওয়া কঠিন। জয়াসুরিয়াও শুরুতে এরকম ছিল, সময়ের সাথে ব্যাটিং টেকনিক এডজাস্ট করায় উতরে যেতে পেরেছে, আফ্রিদি এডজাস্ট করেনি বা করতে পারেনি, যে কারণে টপ অর্ডার থেকে জায়গা হারিয়ে দল থেকে বাদ পড়েছে, ফিরে এসেছে লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে যে মূলত বোলার।

এটাই আফ্রিদির আসল পরিচয়। কিন্তু ৩৭ আর ৪৫ বলের সেঞ্চুরি, ছক্কা মারার সক্ষমতা প্রভৃতি ফ্যাক্টরগুলো এতটাই মিথের ন্যায় রয়ে গেল যে তার অনুরাগীরা তাকে একজন স্ট্রোক প্লেয়ার হিসেবে ভেবে নিল, মধ্যিখানে তার ইফেক্টিভ বোলিংটা চলে গেল গণনার বাইরে। অথচ ওয়ানডে ইতিহাসে সে-ই একমাত্র ক্রিকেটার যে ফিফটি আর ৫ উইকেটের ঘটনা ঘটিয়েছে ৩ বার!

ওয়েস্ট ইন্ডিজের আন্দ্রে রাসেলকে দেখলে আমার তরুণ বয়সের আফ্রিদিকে মনে পড়ে। ২০১১ বিশ্বকাপে রাসেলকে যখন প্রথম দেখি সে পুরোদস্তুর পেস বোলার, কিন্তু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে স্লগিংয়েও পারঙ্গমতা দেখাচ্ছিল। আজ কয়েক বছরের ব্যবধানে রাসেল হয়ে গিয়েছে ছক্কা হিটিংয়ের সিম্বল, পেস বোলিংটা বোনাস!

প্রশ্ন হলো, আফ্রিদিকে যদি স্লগার বলি তার ওয়ানডেতে ৮০০০+ রান আর ৫ টেস্ট সেঞ্চুরিকে ফ্লুক বলতে হবে কিনা। কিন্তু এটা অযৌক্তিক হবে, কারণ ৮০০০ রান কোনো ফেলনা সংখ্যা নয়, টেস্টে ওপেনার হিসেবে ৫টা সেঞ্চুরি করতেও ব্যাটসম্যানশিপের পরীক্ষা দিতে হয়। টেস্টে তার গড় ৩৬ এর বেশি। তার মানে ব্যাটিং সত্তাকে স্লগার ট্যাগের অধীনে রাখা সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নয়।

কিন্তু তার ব্যাটিং কৌশল স্লগারের মত এটাও তো সর্বাংশে সত্য। স্পিন বলে অ্যাক্রোস দ্য লাইন খেলা, পেস বলে গায়ের জোরে মিড উইকেট আর লং অন-লং অফ দিয়ে উড়িয়ে মারা ব্যতিরেকে তার স্কোরিং শট কোথায়?

তার চাইতে বিষয়টাকে এভাবে দেখা যায়, ক্রিস গেইলও তো অতিমাত্রায় প্রেডিক্টেবল ব্যাটিং করে ওয়ানডেতে ১০০০০+ রান করেছে। কিন্তু পার্থক্য হলো, গেইল নিজের ব্যাটিং নিয়ে কাজ করেছে, আফ্রিদি করেনি। তবু একজন ক্রিকেটার ৪০০ এর কাছাকাছি (৩৯৮) ম্যাচ খেললে মাত্র ২০% ম্যাচেও যদি লাক-ফেভার করে তার ৮০ টা ৫০+ ইনিংস থাকার কথা। আফ্রিদির সেরকম ইনিংস ৫০ এর কম। প্রথমত, সে ৩৯৮ ম্যাচে টপ অর্ডারে খেলেনি, ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ভাগ পুরোটাই লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে চালিয়ে গিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, যেখানেই ব্যাটিং করুক পাকিস্তানের ভঙ্গুর ব্যাটিং লাইন আপ এর কারণে ব্যাট করার পর্যাপ্ত সুযোগ সে পেয়েছে। কিন্তু ওয়ান ডিরেকশনাল বৈচিত্রহীন ব্যাটিংয়ে সে প্রতিপক্ষের ট্র‍্যাপে সহজ শিকারে পরিণত হয়েছে। ফলে তার ব্যাটিং স্কিলকে কিছুটা ভাগ্যসহায়ক হিসেবেই দেখতে চাই।

কিন্তু ফ্যানদের বয়েই গিয়েছে ওসব নিয়ে ভাবতে, তারা ব্যাটসম্যান আফ্রিদির মরীচিকাতেই ব্যর্থ মনোরথে ছুটতে থাকে।

অবসর নিয়ে নাটকের প্রসঙ্গটা বুঝতে আফ্রিদির ব্যক্তিত্বের ধরন বোঝাটা জরুরী।

আমাদের মুস্তাফিজ, রুবেলরা যেমন সুবিধাবঞ্চিত পরিবার থেকে উঠে এসেছে, এবং ফলশ্রুতিতে তাদের মধ্যে মাথা খাটানো প্রবণতা গড়ে ওঠেনি, আফ্রিদি যে জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, পাকিস্তানের প্রেক্ষিতে তারা কিছুটা পশ্চাৎপদ।

নীতি-নৈতিকতার চর্চা মধ্যবিত্ত শ্রেণিতেই প্রবল। প্রান্তিক শ্রেণি (উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত) এর মধ্যে নৈতিকতার বাঁধন অনেক ক্ষেত্রেই শিথিল। কাজের বুয়া শ্রেণিটিকে স্যাম্পল হিসেবে নিতে পারেন, তাদের চরিত্র পর্যালোচনা করলেই মূল্যবান ইনসাইট পাওয়া যাবে।

এই শ্রেণির মানুষেরা পরিচয় সংকটে ভোগে, অনিরাপত্তাজনিত কারণে তারা কাউকে সহসা বিশ্বাস করতে পারে না, এবং নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যে কোনো কিছু করতে পারে।

পাকিস্তানের মধ্যে আন্তঃগোষ্ঠী কলহের চিরায়ত ঐতিহ্য রয়েছে, যে কারণে পাকিস্তান দলে প্রতিভার অভাব না থাকলেও তারা টিম হিসেবে কখনোই ধারাবাহিকতা দেখাতে পারে না।

আফ্রিদির অবসর বিভ্রান্তি স্বার্থপরতা আর চাতুর্যের সাথে বুদ্ধিহীনতার এক উদ্ভট সংমিশ্রণ। চতুর হওয়ার জন্য যতটুকু বুদ্ধিবৃত্তিক স্মার্টনেসের প্রয়োজন, আফ্রিদির তা নেই, ফলে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীকে স্যুট-টাই পরিহিত অবস্থায় যেমন বেমানান লাগে, আফ্রিদির চাতুরিগুলোও শেষমেষ হাস্যকর হয়ে ওঠে। ক্রিমিনাল হতে গেলে নিজে ক্রিম হতে হয়, সরিষার তেল দিয়ে ক্রিমের কাজ চলে না।

কিন্তু বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি খেলে বেড়ানো, বা বিভিন্ন দেশে আফ্রিদির লক্ষ লক্ষ ফ্যান-ফলোয়ারের সামাজিক ভিত্তি কী তবে?

এটা তো সহজ উত্তর, যে ব্যাটসম্যান ১১ বল টিকলে একটা ছক্কা মারার সম্ভাবনা থাকবে সে যদি হাত ঘুরাতে পারে টি-টোয়েন্টি ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগে তাঁর চাহিদা থাকবেই। আফ্রিদি তো মোর দ্যান হ্যান্ডি অলরাউন্ডার৷ তাছাড়া কেবল বাংলাদেশের দর্শক সংবেদনহীন, অন্য দেশে সংবেদনশীল, এমন সরলীকৃতও নয় ব্যাপারটা। দর্শকের বড় অংশই পয়সা উসুল বলতে চার-ছক্কা মারা আর বোলারের বিচিত্র সেলিব্রেশন দেখা বুঝে থাকে। আফ্রিদির সেলিব্রেশনেও তো স্বকীয়তা বিদ্যমান।

তবে ফ্যান বা মিডিয়ার বাইরে যদি ক্রিকেটার হিসেবে দেখি, তবে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সে নিঃসন্দেহে অলটাইম গ্রেটদের কাতারে থাকা ডিজার্ভ করে, আর যদি এন্টারটেইনমেন্ট ভ্যালুকে বিবেচনায় নিই, সে উপমহাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেই এক বর্ণিলতম চরিত্র, যাকে আপনি পছন্দ কিংবা অপছন্দ যেটাই করুন, কোনো ভাবেই উপেক্ষা করতে পারবেন না।

আফ্রিদিকে ওভাররেইট করার কাউন্টার এটাকে গিয়ে তাঁকে আন্ডারএস্টিমেট করা হচ্ছে কিনা সে দিকে সচেতনতা বজায় রাখাও ক্রিকেট সংবেদনশীলতার বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link