কার্ডিফ, ২০০৫—এক বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার মতো দানবীয় শক্তিকে পরাস্ত করে সেদিন যে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল, ঠিক বারো বছর পর, একই মাটিতে, সেই স্বপ্নে নতুন প্রাণ দিল বাংলাদেশ, দ্য টাইগার্স। ২০১৭ সালের সেই বিকেলে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে এক অলৌকিক প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখেছিল বাংলাদেশ।
৩৩ রানে ৪ উইকেট নেই। চারদিক থেকে শুধু ধ্বংসস্তূপের গন্ধ আসছে। যেন আরেকটি পরাজয়ের গল্প লেখা হয়ে গেছে। কিন্তু তখনই দৃশ্যপটে এলেন দুই নায়ক—সাকিব আল হাসান এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে তারা গড়লেন এক অনবদ্য মহাকাব্য। ২২৪ রানের জুটি গড়ে বাংলাদেশকে এনে দিল এক অবিশ্বাস্য জয়।
নিউজিল্যান্ড দিয়েছিল ২৬৬ রানের লক্ষ্য। চ্যালেঞ্জ কঠিন, কিন্তু অজেয় নয়। তবে শুরুতেই যেন ধ্বংসের ঘন্টা বেজে ওঠে। তামিম ইকবাল প্রথম ওভারেই এলবিডব্লিউ। সাব্বির রহমান সুইং বুঝতে না পেরে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন। সৌম্য সরকারের স্টাম্প উড়ে গেল। ব্যর্থতার হ্যাটট্রিক সম্পন্ন করেন মুশফিকুর রহিমও। স্কোরবোর্ডে তখন ৩৩ রানে ৪ উইকেট।
কার্ডিফের বাতাসে তখন হাহাকার। বাংলাদেশি সমর্থকদের মুখ থমথমে। জয়ের স্বপ্ন থেকে যেন হাজার মাইল দূরে চলে গেছে দল। কিন্তু ক্রিকেটে কখনো কখনো কিছু গল্প রচিত হয়, যা আগে কেউ কল্পনাও করতে পারে না।
সেই চাপের মধ্যেই ব্যাটিংয়ে নামলেন সাকিব আর মাহমুদউল্লাহ। তারা জানতেন, রক্ষণাত্মক হয়ে টিকে থাকলে হবে না। রুখে দাঁড়াতে হবে, লড়াই করতে হবে। শুরুটা করলেন চিরচেনা ভঙ্গিতে—আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে। ১৩তম ওভারে দুজনই হাঁকালেন চারের বাউন্ডারি। যেন ধ্বংসের মধ্যে নতুন জীবনের ইঙ্গিত!
নিয়মিত সিঙ্গেলস, মাঝে মাঝে বাউন্ডারি—গুটি গুটি পায়ে তারা এগিয়ে যেতে থাকলেন। ২৯তম ওভারে সাকিব তুলে নিলেন ফিফটি। রানাতুঙ্গার মতো শট খেলে থার্ড ম্যান অঞ্চলে বল ঠেলে এগিয়ে গেলেন তিনি। ৩১তম ওভারে ফিফটি স্পর্শ করলেন মাহমুদউল্লাহ। নিউজিল্যান্ড তখন বুঝতে পারল, তারা এক মহাবিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সাকিব তখন অপ্রতিরোধ্য। ৪৬তম ওভারে ফাইন লেগের উপর দিয়ে ছক্কা হাঁকিয়ে তুলে নিলেন নিজের সপ্তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি। পুরো গ্যালারি তখন দাঁড়িয়ে সম্মান জানাচ্ছে তাকে। নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়রাও হাত মিলিয়ে প্রশংসা জানালেন। কিন্তু তখনও কাজ শেষ হয়নি।
শেষ পর্যন্ত যখন সাকিব বোল্ড হয়ে ফিরলেন, জয় তখন প্রায় নিশ্চিত। মাহমুদউল্লাহও থামলেন না। ১০৭ বলে ১০২ রানের এক মহাকাব্যিক ইনিংস খেলে দলকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত মসাদ্দেক হোসেনের ব্যাট থেকে আসা বাউন্ডারিতে লেখা হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা জয়।
এটা সাধারণ কোনো ম্যাচ জেতার গল্প নয়। এটি ছিল অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের গল্প। ২০০৫ সালে যেখানে বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন সূচনা হয়েছিল, ঠিক সেখানেই বারো বছর পর আরও একবার ইতিহাস রচনা করলো মাশরাফি বাহিনী।
মাশরাফির নেতৃত্ব, মোসাদ্দেকের স্পিন জাদু, সাকিব-মাহমুদউল্লাহর বীরত্ব—সব মিলিয়ে এটি এক মহাকাব্যিক অধ্যায়। ক্রিকেট বিশ্ব আরেকবার দেখল, বাংলাদেশ কখনো হার মানতে শেখেনি। কার্ডিফ সাক্ষী হয়ে থাকল বাংলাদেশের এক নতুন সূর্যের উদয়ের। ড্রেসিংরুমের ব্যালকনিতে হাস্যোজ্জ্বল ও উদ্বেলিত মাশরাফি – এই দৃশ্যটা লেখা হয়ে গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসের পাতায়।