সাকিব কী সোবার্সেরও চেয়েও বড়!

ক্রিকেটে অলরাউন্ডার শব্দটা বললেই ভেসে আসে ইয়ান বোথাম, ইমরান খান, গ্যারি সোবার্স কিংবা আজকের সাকিব আল হাসান বা বেন স্টোকসদের নাম।

যারা ব্যাট হাতে যতটুকু ভূমিকা রেখেছেন বল হাতেও দলের জন্য ঠিক ততটাই কার্যকারী ছিলেন। দলে একজন নিখাদ অলরাউন্ডার থাকা মানে দলে বাড়তি একজন বোলার বা ব্যাটসম্যান খেলানোর সুযোগ।

‘নিখাদ’ শব্দটা এজন্যই বললাম কারণ এখন কোনো ব্যাটসম্যান পার্টটাইম বোলারের কাজ করলে তাকেও অলরাউন্ডার বলা হয়। তবে উপরে যাদের নাম আছে তাঁদের সবাই একজন জেনুইন বোলার ও জেনুইন ব্যাটসম্যান। বিশেষ করে যখন সেরাদের নিয়ে কথা হবে তখন অবশ্যই এই কোয়ালিটি থাকা আবশ্যক।

ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার কে?

এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা সত্যিই কঠিন। এখানে অনেকগুলো বিষয়ই বিবেচনায় আনা জরুরি। কোন দেশের বিপক্ষে পারফর্ম করছে কিংবা কোন ম্যাচে পারফর্ম করছেন সেটাও বেশ বড় ব্যাপার। বড় দলের বিপক্ষে বা বড় মঞ্চে পারফর্ম করার কীতির্ত অবশ্যই বেশি।

আবার ম্যাচে ক্রিকেটারের ইমপ্যাক্ট কতখানি এটাও গুরুত্বপূর্ণ। সবমিলিয়ে সেরা বাছাই করা জটিল তো বটেই মোটামুটি অসম্ভব ব্যাপার। তাই আমরা সংখ্যার দারস্ত হতে পারি।

সাধাররণত যেই নিয়মটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় সেটি দিয়েই শুরু করি। কোনো অলরাউন্ডারের ব্যাটিং গড় থেকে বোলিং গড় বিয়োগ দেয়া হয়। সেখানে যার পয়েন্ট যত বেশি তিনি ততো ভালো অলরাউন্ডার। তবে এই পদ্ধতিতে অনেক ফাঁক থেকে যায়। দলের জয়ে বা ম্যাচে তাঁর ইমপ্যাক্ট কতটা সেটা কখনোই বোঝা যায়না এখান থেকে।

তবে টেস্ট ক্রিকেটের ক্ষেত্রে একটি ফরম্যুলায় মোটামুটি এসব সমস্যার সমাধান করা যায়। সেক্ষেত্রে অবশ্য অলরাউন্ডারকে অন্তত ১৫০০ রান ও ৫০ টি টেস্ট উইকেট থাকতে হবে। এখানে মোট পাঁচটি ইনডেক্স ব্যবহার করা হচ্ছে। পাঁচটি ইনডেক্সে মিলে মোট ১০০ পয়েন্ট এর মধ্যে যার সর্বোচ্চ পয়েন্ট থাকবে তাকেই আমরা সেরা অলরাউন্ডার বলে ধরে নিতে পারি। ইনডেক্স গুলো হলো-

  • ব্যাটিং ইনডেক্স ( ২৫ পয়েন্ট)+
  • বোলিং ইনডেক্স ( ২৫ পয়েন্ট)+
  • অলরাউন্ড কন্ট্রিবিউশন পার টেস্ট ইনডেক্স ( ২০ পয়েন্ট)+
  • অলরাউন্ড ইমপ্যাক্ট ইনডেক্স ( ২০ পয়েন্ট)+
  • অলরাউন্ড হাই ইমপ্যাক্ট ইনডেক্স ( ১০ পয়েন্ট)

ব্যাটিং ইনডেক্স

এখানে অলরাউন্ডারের ব্যাটিং গড়কে মূল রসদ হিসেবে নেয়া হবে। ব্যাটিং এভারেজ ৫৭.৫ কে এখানে সর্বোচ্চ ধরে নেয়া হবে। অর্থাৎ যদি কোনো অলরাউন্ডারের ব্যাটিং এভারেজ ৫৭.৫ হয় তাহলে তিনি ২৫ পয়েন্টই পাবেন। তবে কমপক্ষে ১৫০০ রান ও ৫০ টি টেস্ট উইকেট নিয়েছেন এমন অলরাউন্ডারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় গ্যারি সোবার্সের ৫১.৪৭। তাই ব্যাটিং ইনডেক্সের ২৫-এ তিনি সর্বোচ্চ ২২.৪ পয়েন্ট পেয়েছেন।

বোলিং ইনডেক্স

এখানে হিসাব করা হবে অলরাউন্ডারের বোলিং এভারেজ। এখানে ২০.০০ এভারেজ কে বেঞ্চমার্ক ধরে পয়েন্ট দেয়া হবে। এক্ষেত্রে অলরাউন্ডারদের মধ্যে রিচার্ড হ্যাডলের বোলিং এভারেজ সর্বনিন্ম ২২.৩০। ফলে তিনি পাচ্ছেন সর্বোচ্চ ২২.৪ পয়েন্ট।

ছবি: ইএসপিএন ক্রিকইনফো

অলরাউন্ড কন্ট্রিবিউশন পার টেস্ট ইনডেক্স

এখানে কোনো অলরাউন্ডারের খেলা প্রত্যেক ম্যাচের পারফর্মেন্সই বিবেচনায় আনা হবে। প্রথমে তিনি ম্যাচে যত রান করেছেন তার সাথে ২৫ রান যোগ করা হবে। তাঁর সাথে যত উইকেট পেয়েছেন তা গুন করা হবে। এখানে কারো ১৮০ হলে তাঁকে ২০ পয়েন্ট দেয়া হবে।

এখানে সর্বোচ্চ ১৬৫ আছে রবিচন্দ্রণ অশ্বিনের। তাই তিনি পাচ্ছেন সর্বোচ্চ ১৮.৩ পয়েন্ট। এই ইনডেক্সটির মাধ্যমে যেকোনো একটিতে বেশি ভালো করলে অন্যটি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব।

অলরাউন্ড ইমপ্যাক্ট ইনডেক্স

এটি নির্ধারিত হবে কোনো নির্দিষ্ট ম্যাচের অলরাউন্ডার হিসেবে তাঁর পারফর্মেন্সের উপর। যেমন কোনো ম্যাচে ব্যাট-বল দুটোতেই ভালো করতে পারেন ( ৭৫ রান ও তিনটি উইকেট ) কোনো ম্যাবে ব্যাটিংটা বেশি ভালো হতে পারে ( ১০০ এর বেশি রান বা ২টির বেশি উইকেট ) আবার কোনো ম্যাচে বোলিং টা বেশি ভালো করতে পারেন ( ৫০ এর বেশি রান ও ৪ বা এর বেশি উইকেট )।

যদি কোনো ম্যাচে একজন অলরাউন্ডার ৫০ এর কম রান করেন আবার উইকেট বা ২ টির কম উইকেট পান তাহলে সেটাকে অলরাউন্ডিং পারফর্মেন্স হিসেবে ধরা হবেনা। এখন একজন অলরাউন্ডার কতটি ম্যাচে ৫০ এর বেশি রান ও ২ টি বা তারচেয়ে বেশ উইকেট পেয়েছেন সেটিকে তাঁর খেলা মোট ম্যাচ দিয়ে ভাগ করা হবে।

ছবি: ইএসপিএন ক্রিকইনফো

এখানে ৪৫% ম্যাচে এই শর্ত পূরণ করা হলে তাঁকে সর্বোচ্চ ২০ পয়েন্ট দেয়া হবে। এক্ষেত্রে সাকিব আল হাসান তাঁর খেলা ৫৭ টি টেস্টের মধ্যে ২৩ টেস্টেই ( ৪০.৪ শতাংশ)  এই শর্ত পূরণ করেছেন। তাই অলরাউন্ড ইনডেক্সে তিনি সর্বোচ্চ ১৭.৯ পয়েন্ট পেয়েছেন।

অলরাউন্ড হাই ইমপ্যাক্ট ইনডেক্স

এখানে অলরাউন্ডার হিসেবে সবচেয়ে ভালো পারফর্মেন্স গুলোই বিবেচনা করা হবে। এক্ষেত্রে ব্যাটিং ও বোলিং দুই ডিপার্টমেন্টেই ইমপ্যাক্ট ফুল পারফর্মেন্স করা জরুরি। এখানে একটি টেস্ট ম্যাচে অন্তত ১০০ রান ও কমপক্ষে চার উইকেট নেয়া পারফর্মেন্স গুলোই বিবেচনা করা হবে।

কোনো অলরাউন্ডার তাঁর খেলা ম্যাচের ১৭.৫ শতাংশ ম্যাচে এই কীর্তি করতে পারলে তিনি সর্বোচ্চ ১০ পয়েন্ট পাবেন। এখানেও সাকিব আল হাসান তাঁর খেলা ৫৭ ম্যাচের ৯ ম্যাচেই ( ১৫.৭৮ শতাংশ ) এই কীর্তি করে পেয়েছেন সর্বোচ্চ ৯ পয়েন্ট।

ছবি: ইএসপিএন ক্রিকইনফো

এই ফর্ম্যুলাতে ১০০ এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৭৭.১ পয়েন্ট পান তিনি। তাঁর পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে স্যার গ্যারি সোবার্স ( ৭৬.৭ পয়েন্ট)। এক্ষেত্রে ইয়াম বোথাম, ইমরান খান, জ্যাক ক্যালিসদের মতো গ্রেট সব অলরাউন্ডারও সাকিবের থেকে কম পয়েন্ট পেয়েছেন।

এরপরেও বিতর্ক হতে পারে সাকিব আদো সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার কিনা তবে তাঁর থেকে বেশি ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারেননি অন্য কোনো অলরাউন্ডারই। সেটা অলরাউন্ড ইমপ্যাক্ট ইনডেক্স ও অলরাউন্ড হাই ইমপেক্ট ইনডেক্স দেখলেই বোঝা যায়।

ফলে ক্রিকেটটা খুব গভীর ভাবে অনুসরণ করলেই বোঝা যায় অলরাউন্ডার হিসেবে কেনো তিনি সেরাদের সেরা। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা গ্যারি সোবার্সের ব্যাটিং অসাধারণ হলেও বোলিং টা সে তুলনায় কার্যকর ছিল না। ফলে ব্যাট-বল দুই ডিপার্টমেন্টেই দলে ভূমিকা রেখে গ্রেট সব অলরাউন্ডারদেরও ছাড়িয়ে গিয়েছেন সাকিব আল হাসান।

এই মুহুর্তে সাকিবের ব্যাটিং গড় ৩৯.৬৯ এবং বোলিং গড় ৩১.২০। এছাড়াও সাকিবের এক ম্যাচে ১৪৩ রান ও ১০ উইকেট নেয়ার কীর্তিও রয়েছে। সাকিবের সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিকতা। শেষ ১৩ টেস্টের ১০ টিতেই তিনি ইমপ্যাক্ট পারফর্মেন্স করেছেন।

তাছাড়া ক্যারিয়ারের অসাধারণ সময় পার করা সাকিবের সামনে এখনো অনেকটা সময় আছে। আগামী কয়েক বছরে এই সংখ্যা গুলো হয়তো তিনি আরো অবিশ্বাস্য করে তুলতে পারবেন। ফলে তাঁর ক্যারিয়ার শেষে হয়তো সবাই নির্দ্বিধায় বলতে পারবে যে সাকিবই সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার। যদিও পরিসংখ্যান এখনই সেটা বলে।

-ইএসপিএন ক্রিকইনফো অবলম্বনে

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link