সাকিব রহস্যের সমাধান

কোনো খেলোয়াড়েরই মানসিকভাবে অপ্রস্তুত অবস্থায় খেলা চালিয়ে যাওয়া ঠিক না। সেটা যদি হয় ক্রিকেটের মতো একটা জটিল মেন্টাল গেইম, তাহলে তো আরও না।

সেদিন রাতে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ার আগে গণমাধ্যমে বেশ কিছু কথা বলে যান সাকিব আল হাসান। এই মুহূর্তে তিনি মানসিক ও শারীরিকভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার অবস্থায় নেই বলে জানান। আসলে তিনি না কি আগ্রহই পাচ্ছেন না খেলাটিতে। তাঁর না কি একটা বিরতি দরকার। সেটা কোনো নির্দিষ্ট সংস্করণ থেকে নয়, একেবারে ক্রিকেট খেলা থেকেই। সাকিব আরও জানান, সদ্য সমাপ্ত আফগানিস্তান সিরিজে কোনো সংস্করণই মাঠে তিনি উপভোগ করতে পারেননি।

এদেশে সাকিব অন্য যে-কারোর চেয়ে ক্রিকেটটা ভালো বুঝেন বলে সর্বজনস্বীকৃত। আমি বিশ্বাস করতে চাই, ক্রিকেটের চেয়ে সাকিব আরো বেশি ভালো বুঝতে পারেন নিজেকে। সে হিসেবে তাঁর কথাগুলাকে আর দশটা মানুষের মতো ছুতা মনে না করে একদম সত্য হিসেবে ধরে নিয়েছি আমি।

এমনিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নির্ভার হয়ে খেলার কোনো সুযোগই নেই। এখানে দেশের প্রতি একটা বিশেষ দায়বদ্ধতা কাজ করে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি যে চাপটা থাকে সেটা হলো প্রত্যাশার চাপ। সে প্রত্যাশা পুরো দেশের। এখানে আপনাকে ভালো খেলতে হবে। সবসময় যে পারবেন তা না। তবে আপনার একাগ্রতা ও চেষ্টা থাকতেই হবে। আর এখানেই কি না সাকিব কোনো আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছেন না এই মুহূর্তে!

সাকিব মনে করছেন, তাঁর নিজের প্রতি নিজের প্রত্যাশা, মানুষের প্রত্যাশা এবং দলের প্রত্যাশা যদি পূরণ করতে না-ই পারেন তাহলে এটা তাঁর সতীর্থদের সাথে প্রতারণা করা হবে। তিনি নিজের সেরা অবস্থায় থাকলেও খেলতে নামলেই যে পারফর্ম করবেন, সে নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু অন্তত জানবেন যে দেশের হয়ে পারফর্ম করার জন্য তিনি নিজের সেরা অবস্থায় আছেন। তবে কোনো সম্ভাবনা নেই জেনেও যদি খেলাটা চালিয়ে যান তাহলে সেটা সময় নষ্ট করা, অন্য একজনের জায়গা নষ্ট করা এবং দেশের ক্রিকেটের সাথে গাদ্দারি করা হবে বলেই বিশ্বাস তাঁর।

গত রাতে সাকিব একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। তিনি জাতীয় দলে প্যাসেঞ্জার হয়ে থাকতে চান না। এটা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা খুদে বার্তা। প্যাসেঞ্জার হয়ে থাকা বলতে সাকিব কী বুঝাতে চেয়েছেন? আমার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে একটু ভাঙানোর চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে যদি একটা গাড়ির সাথে তুলনা করা হয় তাহলে দলের প্রত্যেকটা ক্রিকেটার হলেন সে গাড়ির চালক। গাড়ির চালকের যেমন যাত্রীদের স্ব স্ব গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব থাকে তেমনি দলের ক্রিকেটারদের দায়িত্বও দলকে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া।

কিন্তু গাড়িকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ায় যাত্রীদের কি প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা থাকে? না। তেমনি সাকিবও চান না জাতীয় দলে প্যাসেঞ্জার বা যাত্রী হয়ে থাকতে। মানে কোনো অবদান না রেখেই শুধু জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার বলে দলে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই তাঁর। আচ্ছা, একদিক দিয়ে ভাবলে কিন্তু যাত্রীরা হলেন গাড়ির বোঝা। সে হিসেবে সাকিব কি প্যাসেঞ্জার হয়ে থাকাকে দলের বোঝা হিসেবে থাকাটাকেই বুঝিয়েছেন? খুব সম্ভবত তা-ই।

আমি মনে করি, সাকিব ঠিক সিদ্ধান্তটাই নিয়েছেন। যদিও তিনি বলেছেন শারীরিক ও মানসিকভাবে খেলা চালিয়ে যাওয়ার অবস্থায় নেই, তারপরেও মানসিক ব্যাপারটাকেই আমি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ শারীরিকভাবে শতভাগ সুস্থ না থাকলেও খেলা যায়। সেটা বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটারই করে দেখিয়েছেন। সাকিব নিজেও তো এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ হয়ে রয়েছেন। ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বাঁহাতের কড়ে আঙুলের চোটে টানা ব্যথানাশক ইঞ্জেকশন নিয়ে তিনি শুধু খেলেই যাননি, পারফর্মও করেছিলেন। কিন্তু মানসিকভাবে ঠিকঠাক না থাকলে তা কি সম্ভব হতো? উত্তরটা নিশ্চয় আপনারও জানা।

মানসিক অবস্থা খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় যেটাকে সাধারণত আমাদের দেশে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয় না। সাকিব বলেছেন, তিনি আপাতত দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের ওয়ানডে থেকে বিরতি চেয়েছেন। এর মধ্যে যদি ঠিকঠাক সেরে ওঠতে পারেন তাহলে টেস্ট সিরিজে অংশ নিবেন। সাকিব যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়ারই কোনো তাড়া দেখি না আমি।

শুনলাম, তিনি ক্রিকেট অপারেশন্সে ছুটির আবেদন জানিয়েছেন। ক্রিকেট অপারেশন্স চেয়ারম্যান না কি ভাবার জন্য দুইদিন সময় নিয়েছেন এবং সাকিবকেও ভাবতে বলেছেন। এই দুইদিনে কিছুই হবে না। সাকিব গত রাতে যেভাবে তাঁর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন তাতে মাত্র দুইদিনে কোনো আমূল পরিবর্তন হওয়ার সম্ভবনা নেই। আমার বিশ্বাস, ক্রিকেট বোর্ড সাকিবের সিদ্ধান্তটাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিবে যেটা দেওয়া উচিত বলেই মনে করি।

কারণ এই অবস্থায়ও সাকিব খেলতে পারবেন ঠিকই কিন্তু উপভোগ করতে পারবেন না, যেমনটা পারেননি সদ্য সমাপ্ত আফগানিস্তান সিরিজে। আর একজন যত ভালোই ক্রিকেটার হন না কেন, মানসিকভাবে চাঙ্গা না থাকলে বা মাঠে খেলাটা যদি উপভোগই করতে না পারেন তাহলে তাঁর পক্ষে পারফর্ম করা অসম্ভব। আফগানিস্তান সিরিজে সাকিবের পারফরম্যান্সও যে সে সাক্ষ্যই দিচ্ছে!

তাছাড়া সাকিবেরও একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় এসে গেছে। পরিকল্পনা করে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তিনি বিরতি নিয়ে নিতে পারেন ঠিক বেন স্টোকসের মতো। সেক্ষেত্রে ভেবেচিন্তে মনঃস্থির করে বোর্ডের সাথে একান্তে বসে দ্রুতই একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তিনি।

তাতে সাকিব ও তাঁর দল, উভয়ের জন্যই মঙ্গল। এভাবে এক সিরিজ খেলে আরেক সিরিজে বিশ্রাম নেওয়ার ক্রম চলতে থাকলে দলের জন্য পরিকল্পনা সাজাতেও সমস্যা। সাকিব একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিরতি নিলে ম্যানেজমেন্ট ওই সময়ের জন্য তাঁকে ছাড়া একটা পরিকল্পনা সাজাতে পারবে। আর সাকিবের জন্য তো জাতীয় দলের দরজা সবসময়ই খোলা। তাই ওই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই যদি তিনি জাতীয় দলে ফেরার জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত মনে করেন নিজেকে তাহলে বোর্ড যে তাঁকে সাদরেই গ্রহণ করবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link