ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত বিতর্কগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে শেন ওয়ার্ন বনাম মুত্তিয়া মুরালিধরন। তাঁদের মধ্যে কে সর্বকালের সেরা স্পিনার? এই প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত কেউই দিতে পারবে না। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একটা জিনিস বলতে চাই, পছন্দের টেস্ট একাদশ গঠন করতে বললে স্পেশালিস্ট স্পিনার হিসেবে সবাই ওয়ার্নকেই বেছে নেন। মুরালি সব সময় উপেক্ষিতই থাকেন। কিন্তু কেন?
মুরালির চাইতে ওয়ার্নকে এগিয়ে রাখার একটি কারণ সম্ভবত ওয়ার্ন লেগ স্পিনার বলে। কেন বললাম তার কারণ লেগ স্পিন নিয়ে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের মাঝে সব সময় একটা আলাদা ফ্যাসিনেশন কাজ করে। লেগ স্পিনারের হাতে ভ্যারিয়েশন বেশি, সাদা চোখে দেখলে অফ স্পিনের চেয়ে লেগ স্পিনকে মনে হয় অনেক বেশি ফ্যাশনেবল, অনেক বেশি আকর্ষণীয়। তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়।
এবারে আসুন একটু পরিসংখ্যান দেখি। ১৩৩ টেস্টে মুরালির উইকেটসংখ্যা ৮০০, যেখানে ১৪৫ টেস্টে ওয়ার্নের শিকার ৭০৮। মুরালির বোলিং গড় ২২.৭২, ওয়ার্নের ২৫.৪১। মুরালির স্ট্রাইক রেট ৫৫, ওয়ার্নের ৫৭। মুরালি ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছে ৬৭ বার, ওয়ার্ন ৩৭ বার! মুরালি ম্যাচে দশ উইকেট নিয়েছে ২২ বার, ওয়ার্ন ১০ বার!
হ্যাঁ, পরিসংখ্যানে যে মুরালিই এগিয়ে সেটা দিনের আলোর মতই স্পষ্ট। তাহলে মুরালিকে রেখে ওয়ার্নকে কেন বেছে নেয় সবাই ? কারণ শুধুমাত্র পরিসংখ্যানই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মাপকাঠি হতে পারে না।
মুরালিকে পিছিয়ে রাখার আরেকটি কারণ হচ্ছে, মুরালির ৮০০ উইকেটের ১৭৬ টাই এসেছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে (২৫ টেস্টে)। যেখানে এই দুই দলের বিপক্ষে মাত্র ৩ টেস্ট খেলে ওয়ার্ন পেয়েছেন সাকুল্যে ১৭ উইকেট।
হ্যাঁ, বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মুরালি অনেক বেশি ম্যাচ খেলেছেন তাই উইকেটও পেয়েছেন বেশি, সোজা হিসাব! এতে মুরালির কোন দোষ নেই। আবার এটাও ঠিক যে, এই দু’দলের বিরুদ্ধে খেলা ম্যাচের স্ট্যাটস তার ওভার-অল ক্যারিয়ার স্ট্যাটসকে অনেকাংশেই সমৃদ্ধ করেছে। যে সুবিধাটা ওয়ার্ন নিতে পারেননি।
এখন বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলা ম্যাচগুলো যদি এক পাশে সরিয়ে রাখি, তাহলে মুরালির পরিসংখ্যান দাঁড়ায় ১০৮ টেস্টে ২৪.৮৭ গড়ে ৬২৪ উইকেট, অন্যদিকে, ওয়ার্নের ১৪২ টেস্টে ২৫.৪ গড়ে ৬৯১ উইকেট।
লক্ষ করুন, বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলে মুরালির ক্যারিয়ার গড় কমেছে ২.১৫ অর্থাৎ আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। ওয়ার্নের বেলায় যা কোন প্রভাবই ফেলেনি।
মুরালির ক্ষেত্রে প্রায়ই একটা অভিযোগ শোনা যায়, তিনি ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ ম্যাচই খেলেছেন উপমহাদেশের স্পিন ফ্রেন্ডলি কন্ডিশনে। মুরালির হোম স্ট্যাটসও তাই ওয়ার্নের থেকে বেটার। শ্রীলঙ্কার ‘স্পিন সহায়ক’ পিচে মাত্র ১৯.৫৭ গড়ে মুরালির ৪৯৩ উইকেটের বিপরীতে অস্ট্রেলিয়ার ‘পেস ফ্রেন্ডলি’ কন্ডিশনে ওয়ার্নের শিকার ২৬.৩৯ গড়ে ৩১৯ উইকেট।
বলা হয়ে থাকে, হোমের তুলনায় এওয়েতে পারফর্ম করা কঠিন। সেই এওয়ে ম্যাচের পরিসংখ্যানে আবার ওয়ার্নই এগিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার বাইরে ওয়ার্নের শিকার ২৪.৬১ গড়ে ৩৮৯ উইকেট। যেখানে শ্রীলঙ্কার বাইরে মুরালি পেয়েছেন ২৭.৮ গড়ে ৩০৯ উইকেট।
এবারে আসি ওয়ার্ন ভার্সেস মুরালি বিতর্কের সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর ‘সাপোর্ট’ প্রসঙ্গে। এই সাপোর্ট জিনিসটা ওয়ার্নের বেলায় একদিক থেকে যেমন এডভান্টেজ ছিল, আরেকদিক থেকে ছিল ডিজএডভান্টেজ। কীভাবে? সেই ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে একটা পরিসংখ্যান দিচ্ছি।
বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ে ব্যতীত শীর্ষ ৭ দলের বিপক্ষে খেলা ১০৭ টেস্টে (বিশ্ব একাদশের হয়ে খেলা ১ টেস্ট কাউন্ট করছি না) মুরালি একাই নিয়েছে ৬১৯ উইকেট আর বাকি বোলাররা মিলে নিয়েছে ৯০০ উইকেট! একই ক্রাইটেরিয়া অনুসারে ১৪২ টেস্টে ওয়ার্নের একার শিকার ৬৯১ উইকেট আর বাকিদের অবদান ১৭৫৪ উইকেট!
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ওয়ার্নের দলে শুধু ওয়ার্ন একা উইকেট নিতেন না, বরং অন্য উইকেট টেকাররা আরো বেশি উইকেট নিতেন। এদের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন গ্লেন ম্যাকগ্রা; ১২৪ টেস্ট খেলা কিংবদন্তি এই পেসারের রয়েছে মাত্র ২১.৬ গড়ে ৫৬৩ উইকেট!
এটা স্বীকার করতেই হবে যে, ওয়ার্ন ক্যারিয়ার জুড়ে ম্যাকগ্রা, গিলেস্পি, ব্রেট লি’র মত উইকেট টেকিং বোলারদের কাছ থেকে যে অসামান্য সাপোর্ট পেয়েছেন, মুরালি সেটা পান নি। হ্যাঁ, মুরালির পাশেও একজন চামিন্দা ভাস ছিলেন, কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিল না। সেক্ষেত্রে ওয়ার্নের জন্য ‘সাপোর্ট’ অবশ্যই একটা অ্যাডভান্টেজ।
তাহলে ডিজএডভান্টেজ কীভাবে? কারণ দলে একাধিক উইকেট টেকিং বোলার থাকায় ওয়ার্নের বেলায় উইকেট পাওয়ার সুযোগও থাকত কম। অনেক সময়ই দেখা যেত ওয়ার্ন বোলিংয়ে আসার আগেই অপনেন্ট টিমের ৬-৭টা উইকেট অলরেডি পড়ে গেছে!
মুরালির বেলায় আবার এই ‘সাপোর্ট না থাকা’টাই ছিল অ্যাডভান্টেজ! মুরালির দলে মুরালিই ছিলেন মূল উইকেট টেকার, ভাস থাকতেন পার্শ্ব চরিত্রে। সবচেয়ে বেশি বোলিং করার সুযোগও মুরালিই পেতেন।
পরিসংখ্যান বলছে, টেস্টে শ্রীলঙ্কার হয়ে এক তৃতীয়াংশ বোলিং মুরালি একাই করেছেন! আর ৪১ শতাংশ উইকেটও তিনি একাই পেয়েছেন! যেখানে ওয়ার্ন পেয়েছেন দলীয় উইকেটের মাত্র ২৮ শতাংশ!
উল্লেখ্য, টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ৭৩৩৯.৫ ওভার বল করেছেন মুরালি। সবচেয়ে বেশি উইকেট তো তাঁরই পাওয়ার কথা! তাই না?
সবশেষে আসি মুরালি-ওয়ার্নের যুগে ‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্পিন খেলা’ ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ প্রসঙ্গে। ওয়ার্ন ও মুরালি দু’জনের ক্যারিয়ারেই একমাত্র ‘অ্যাকিলিস হিল’ ছিল ভারত। কমবেশি দু’জনকেই ভুগতে হয়েছে ভারতের মাঠ এবং ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে।
ভারতের মাটিতে ১১ টেস্ট খেলে মুরালি পেয়েছেন ৪৫ গড়ে ৪০ উইকেট! দুই টেস্ট কম খেলে ওয়ার্নের শিকার ৪৩ গড়ে ৩৪ উইকেট। দুজনের মধ্যে পার্থক্য প্রায় নেই বললেই চলে।
মুরালির ‘অ্যাকিলিস হিল’ প্রসঙ্গে অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার নামটাও বলা যায়। ওয়ার্নের দেশে ৫ টেস্ট খেলে মুরালির শিকার মাত্র ১২ উইকেট, বোলিং গড় ৭৫.৪২!
পরিশেষে বলতে চাই, আপনার একাদশে মুরালিকে রাখবেন নাকি ওয়ার্নকে রাখবেন তা সম্পূর্ণ আপনার সিদ্ধান্ত, আমি ঠিক করে দেয়ার কেউ নই। আমার চোখে মুরালি, ওয়ার্ন দুজনই অলটাইম গ্রেট, এদের একজনকে বেছে নেয়ার সাধ্য আমার নেই।