নীরব লড়াকুর সরব লড়াই

ক্রিকেট মাঠে তিনি এমন কোনো চরিত্র ছিলেন না যে কারণে তাকে মনে রাখতে বাধ্য হবেন ক্রিকেট ভক্তরা। তিনি এমন কোনো রেকর্ডও করে যাননি, যা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে পরবর্তী প্রজন্মের।

টেস্টে ৪৪.৬৬ এবং সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ৩৭.১৯ গড়; একজন মিডিওকর ক্রিকেটারের কথাই জানান দেয়। পরিসংখ্যান হয়তো তাকে মনে রাখবে না। কিন্তু ইংল্যান্ডের সমর্থকরা তাকে ঠিকই মনের মণিকোঠায় স্থান দিয়েছেন। গ্রাহাম থর্প যে সবার আড়ালে থাকলেও নি:শব্দে নিজের কাজটা করে গেছেন সবসময়।

১৯৬৯ সালে সারের ফার্নহ্যামে জন্মগ্রহণ করেন গ্রাহাম থর্প। বড় দুই ভাইয়ের সাথে ছোটবেলায় বাড়ির আঙ্গিনাতেই খেলেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি তার। ছোটবেলায় থর্প ছিলেন মূলত ডানহাতি ব্যাটসম্যান কিন্তু ভাইয়ের সাথে খেলার সময় আঙ্গিনার ছোট লেগসাইডের ফায়দা নিতে বনে যান পুরোদস্তুর বামহাতি ব্যাটসম্যান। পরবর্তীতে বাম হাতেই নেতৃত্ব দিয়েছেন ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপকে।

ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলটাও খেলতেন দারুণ। উভয় খেলাতেই ডাক পেয়েছিলেন অনুর্ধ্ব-১৮ জাতীয় দলের হয়ে, ম্যাচও খেলেছেন দুই দলেই। কিন্তু সারের ছেলে ক্রিকেট না খেলে ফুটবল খেলবে এটা বোধহয় মানতে পারছিলেন না সারের কর্তাব্যক্তিরা।

তাই একবার ফুটবল খেলে বাড়ি ফেবার পর চুক্তিবদ্ধ করে নিলেন থর্পকে। ব্যস ক্রিকেটেই ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন থর্প। বাকিটা ইতিহাস!

টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী লড়াই হচ্ছে ইংল্যান্ড- অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ – দ্য অ্যাশেজ। সেই অ্যাশেজেই ১৯৯৩ সালে নটিংহ্যাম্পশায়ারে অভিষেক ঘটে থর্পের। নিজের অভিষেক ম্যাচেই দ্বিতীয় ইনিংসে ১১৪ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন তিনি।

দ্রুত ম্যাচের পরিস্থিতি কিংবা পিচের প্রকৃতি আন্দাজ করার সক্ষমতা ছিল তার। লাহোরে পাকিস্থানের বিপক্ষে যেমন স্লো উইকেট বুঝতে পেরে মাত্র দুই বাউন্ডারিতে কেবল সিংগেল এবং ডাবলসে ভর করে দারুণ এক সেঞ্চুরি হাঁকান। ঠিক এর বিপরীত ঘটনা ঘটে ক্রাইস্টচার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।

কিউইদেরকে হারাতে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল দ্রুত রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করা। সেদিন যেন তরবারি হয়ে উঠেছিল থর্পের ব্যাট। কিউই বোলারদের কচুকাটা করে ২৩১ বলে করেছিলেন ঠিক ২০০ রান। ১৯৯৮ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন তিনি।

অন্যায়ের বিপক্ষে থর্প ছিলেন সবসময় সোচ্চার। সেসময় ইংলিশ ক্রিকেটাররা বোর্ড থেকে তুলনামূলক কম বেতন পেতেন। অন্যদিকে স্পন্সরদের বদৌলতে ইসিবির আয় ঠিকই বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। একারণে টানা তিন বছর বেতন না বাড়ানোর প্রতিবাদে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের আগে স্পন্সরদের লোগো সম্বলিত জার্সি পড়তে অস্বাকৃতি জানান। পরবর্তীতে ইসিবি তাদের দাবি মেনে নিতে রাজি হয়।

তবে ক্রিকেট ক্যারিয়ার মসৃণভাবে আগালেও ব্যক্তিগত জীবনে অসুখী ছিলেন থর্প। ক্রিকেটের কারণে পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারতেন না তিনি, বেশিরভাগ সময়েই দলের সাথে থাকতে হতো দেশের বাইরে। ফলশ্রুতিতে ফাটল ধরে তার দাম্পত্যজীবনে।

থর্প নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে। এমনকি একবার ভারত সফরের মাঝপথে দল ছেড়ে দেশে ফিরেছিলেন স্ত্রীর অনুরোধে। অল্প বয়সেই অবসর নিয়ে নেন একদিনের ক্রিকেট থেকেও কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ২০০২ সালে স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয়ে যায় তার।

মাঠের বাইরের নানা ঘটনায় ক্রমেই ফর্ম হারিয়ে ফেরেন থর্প। এক সময় বাদ পড়েন দল থেকেও। পরে কাউন্টিতে দারুণ পারফর্ম করে জায়গা ফিরে পান জাতীয় দলে। ২০০৩ সালে ওভালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রত্যাবর্তনের সেই ম্যাচে খেলেন ১২৩ রানের অনবদ্য এক ইনিংস।

নিজের ১০০ তম টেস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে একমাত্র ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে করেন ৬৬ রান। কিন্তু ২০০৫ অ্যাশেজের আগে কেভিন পিটারসেনের উত্থান এবং তার বদলে ইয়ান বেলের উপর নির্বাচকদের ভরসা রাখা সবমিলিয়ে দলে ব্রাত্য হয়ে পড়েন থর্প। ফলশ্রুতিতে ১০০ তম টেস্টেই ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে তার।

১০০ টেস্টের ক্যারিয়ারে ১৬ শতক এবং ৩৯ অর্ধশতকের সাহায্যে ৬,৭৪৪ রান করেন তিনি। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ৮২ টি ম্যাচ খেলে করেন ২,৩৮০ রান। এছাড়াও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার রানসংখ্যা বিশ হাজারের অধিক।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়ার পর অস্ট্রলিয়ার রাজ্য দল নিউ সাউথ ওয়েলশের সাথে কোচ কাম ক্রিকেটার হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন। যদিও তাদের হয়ে কখনো মাঠে নামেননি, কোচ হিসেবেই দায়িত্ব পালন করেছেন পুরোটা সময়। পরবর্তীতে কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ইংল্যান্ড লায়ন্সের হয়ে। বর্তমানে নিযুক্ত আছেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের সহকারী কোচ হিসেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link