শম্বুকগতির সুনীল ও ক্ল্যাসিক ডেনিস অ্যামিস

তখন ওয়ানডে ক্রিকেটে ৩০০’র ওপর রান মানেই জয়ের নিশ্চয়তা। ইংল্যান্ড বোর্ডে জমা করলো ৩৩৫ রান। ৩৩৬ রানের লক্ষ্যে ভারতের হয়ে ওপেনিংয়ে নামা এক ব্যাটসম্যান খেললেন ১৭৪ টি বল। কিন্তু নামের পাশে যোগ করতে পারলেন মাত্র ৩৬ টি রান। ফলে, হারটা অবধারিতই ছিল। হলও তাই। সেই ম্যাচে ভারত হারলো ২০২ রানের ব্যবধানে।

ঘটনাটা ১৯৭৫ সালের, সাত জুন। একদম কাঁটায় কাঁটায় ৪৬ বছর আগের উপাখ্যান। ৭ জুন, ১৯৭৫। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রথম আসরের প্রথম ম্যাচ। আর সে ম্যাচে ১৭৪ বলে অপরাজিত ৩৬ রানে অদ্ভুতুড়ে ইনিংস খেলা ব্যাটসম্যানের নাম সুনীল গাভাস্কার!

৩৩৫ রানের বিশাল টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে সুনীলের এমন কচ্ছপ গতির ইনিংস দেখে বিবিসিতে সেই ম্যাচের ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় টেড ডেক্সটার চরম বিরক্তি নিয়ে একসময় বলেই ফেললেন, ‘অধিনায়কের উচিত এখনই গাভাস্কারকে মাঠে থেকে তুলে নেওয়া।’

দ্য ক্রিকেটার রিপোর্টে লিখলো, ‘Dejected Indians were pathetically pleading with him to die fighting.’

প্রাক্তন ইংলিশ ক্রিকেটার, সাংবাদিক জন উডকুক টাইমসে লিখলেন, ‘From the Mound stand, where the police were kept as busy removing rowdies as if it were the Hill at Sydney, anyone who could break the cordon came to plead with the Indian batsmen to play the game properly. But it was no use.’

সুনীল গাভাস্কারের এমন ইনিংসে তিনি যে শুধুই বিশ্বমিডিয়ায় সমালোচিত হয়েছিলেন তা কিন্তু নয়, নিজ দলের ম্যানেজার গুলাব্রে রামচান্দ তো কোনো রকম রাখঢাক না করেই ক্ষোভ উগ্রে দিয়েছিলেন ঠিক এভাবে, ‘It was the most disgraceful and selfish performance I have ever seen… his excuse [to me] was, the wicket was too slow to play shots but that was a stupid thing to say after England had scored 334.’

তো যাহোক, ১৭৪ বলে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে পুরো ইনিংসে মাত্র ১ বাউন্ডারিতে ৩৬ করা গাভাস্কারের কাছে এমন ইনিংসের ব্যাখ্যা কী ছিল?

তাৎক্ষণিকভাবে সে সময়ে কিছু বলেননি গাভাস্কার। কিন্তু পরে স্বীকার করেন, ‘আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে ইনিংস ছিলো ওটা। ওভাবে খেলাটার আসলে কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। আমি আসলে জানি না কি করতে চেয়েছিলাম! কয়েকবার তো স্ট্যাম্প ছেড়ে সরেও দাড়িয়েছিলাম যাতে অন্তত বোল্ড হয়ে যাই। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। রানও নিতে পারছিলাম না। আউটও হচ্ছিলাম না!’

সুনীল গাভাস্কারের এমন অদ্ভুত ইনিংসটাকে পাশ কাটিয়ে সেই ম্যাচেরই আরেকটি ইনিংসের দিকে তাকানো যাক। ইংল্যান্ডকে সে ম্যাচে ৩৩৪ রানের রানপাহাড়ে বসানোর কৃতিত্বটা যার ছিল তিনি হলেন ডেনিস অ্যামিস। ভারতীয় ওপেনার সুনীল গাভাস্কার লর্ডসের যে মাটিতে ১৭৪ বলে ৩৬ করলেন সেই একই ম্যাচে একই মাটিতে ডেনিস অ্যামিস খেললেন ১৪৭ বলে ১৩৭ রানের ইনিংস।

ডেনিস অ্যামিস ক্যারিয়ারে খেলেছেন মাত্র ১৮ টি ওয়ানডে। ৮৫৯ রানের ছোট্ট ক্যারিয়ারে আছে ৪ টি ওয়ানডে সেঞ্চুরি। এর মধ্যে দুটি সেঞ্চুরিই ইতিহাসের অংশ। নিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে ১৯৭২ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যে সেঞ্চুরিটি হাঁকালেন সেটি শুধু তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারেরই প্রথম সেঞ্চুরি না, ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসেরও প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি!

আবার, লর্ডসে হওয়া প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ১৩৭ রানের ইনিংসটি তাকে দিল বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের স্বীকৃতি! ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরি, আবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরি, এ দুটিরই মালিক তাই ১৮ টি ওয়ানডে খেলা এই ডেনিস অ্যামিস।

জুন মাসের ৭ তারিখটা কি জীবন থেকে মুছেই দিতে চাইবেন সুনীল গাভাস্কার? কিন্তু গাভাস্কারের সমৃদ্ধময় ক্রিকেট ক্যারিয়ার যে তার ক্রিকেটীয় জীবনের সবচেয়ে বাজেতম সে দিনটিকে মুছে দেবার জন্য যথেষ্ট।

সার্বিয়ান-আমেরিকান ঔপন্যাসিক টি ওব্রেহটের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘তোমার জীবনে কি ঘটতে যাচ্ছে, তুমি জানো না। আবার অন্যের জীবনে কি ঘটবে সেটাও তোমার জানা নেই।’

সেদিনের ইনিংসে সমালোচনায় বিদ্ধ হওয়া সুনীল গাভাস্কার তাঁর খেলা পরের ইনিংসেই করেছিলেন ৮৬ বলে ৬৫ রান। বিশ্বকাপ সফর শেষে ম্যানেজারের কড়া রিপোর্ট আর বোর্ডের তিরস্কারে জর্জরিত হওয়া গাভাস্কার ৮ বছর পরে সেই ইংল্যান্ডের মাটি থেকেই জিতেছিলেন বিশ্বকাপ। ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ে দলের গর্বিত এক সদস্যের নাম ছিল সুনীল গাভাস্কার।

শুধু দলীয় সাফল্য নয়, ব্যক্তিগত সফলতাতেও নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম দশ হাজার রান করা ব্যাটসম্যানের কৃতীত্বটা সুনীল গাভাস্কারের।

জীবনটা হয়তো এমনই। হয়তো কিছুটা ধোঁয়াশা, কিন্তু বাকিটায় চরমতম আশা।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link