বিলেতে প্রবাসী প্রোটিয়া জীবন

২০০৯-১০ সালের কথা। ডারবানে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ২৭ রানে তিন উইকেট হারিয়ে রীতিমতো ধুঁকছে সফরকারী ইংল্যান্ড। তখন ক্রিজে এলেন মাত্র দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নামা জোনাথন ট্রট, অপরপ্রান্তে ব্যাট করছেন কেভিন পিটারসেন। নন স্ট্রাইক প্রান্তে যাবার পর হুট করে ট্রটকে থামালেন আম্পায়ার স্টিভ ডেভিস।

‘আমি ঠিক জানি না তুমি ব্যাপারটা ধরতে পেরেছো কিনা। এখন কিন্তু মাঠে থাকা একমাত্র ইংলিশম্যান আমিই।’ আম্পায়ারের কথা শুনেই বুঝে গেলেন ট্রট। তিনি কিংবা পিটারসেন দুজনের জন্মস্থানই যে দক্ষিণ আফ্রিকা।

বাসিল ডি অলিভেইরা থেকে শুরু করে অ্যালান লাম্ব,রবিন স্মিথ, অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস, ম্যাট প্রায়র, কেপি, ট্রট হয়ে সাম্প্রতিক সময়ে থ্রি লায়ন্সদের নিয়মিত মুখ টম কারান, জেসন রয়, কিটন জেনিংস সকলের জন্মস্থানই দক্ষিণ আফ্রিকায়। কিন্তু জাতীয় দলের প্রশ্নে তারা সকলেই জন্মভূমির পরিবর্তে বেছে নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডকে।

ইংল্যান্ডের বহু ম্যাচ জয়ের নায়ক তারা। জন্মসূত্রে চার দক্ষিণ আফ্রিকান ইংল্যান্ডের হয়ে অধিনায়কত্ব করেছেন। এমনকি ইংল্যান্ডের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়কও একজন দক্ষিণ আফ্রিকান। ২০১০ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে অপরাজিত এক হাফ সেঞ্চুরি করে ইংল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো খেতাব এনে দেয়া ক্রেইগ কিসওয়েটারের জন্ম হয়েছিল জোহানেসবার্গে।

এদের মাঝে কেউ কেউ ছোটবেলাতেই পরিবারের সাথে ইংল্যান্ডে চলে আসেন, আবার কেউ কেউ থিতু হন পরিণত বয়সে। অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের কথাই ধরুন না, জোহানেসবার্গ ছেড়ে তার পরিবার যখন লন্ডনে চলে আসে তখন তার বয়স কেবল ছয়। ফলশ্রুতিতে একজন ইংলিশম্যান হয়েই বেড়ে উঠেছেন তিনি। সবাই অবশ্য তার মতো সৌভাগ্যবান নন। অনেকেরই এই পর্যায়ে আসতে পেরোতে হয়েছে হাজারো বাধাঁ।

তথাকথিত সভ্য ইংরেজ সমাজে হতে হয়েছে নানা বৈষম্যের শিকার। ইংল্যান্ডের হয়ে ২০১ ম্যাচে সাড়ে আট হাজার রান করা অ্যালান লাম্ব একবার বলেছিলেন, ‘ইংরেজ সমাজ আমাদের কখনোই মেনে নেয়নি। মিডিয়া আমাকে সবসময়ই খুব বাজেভাবে উপস্থাপন করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকান লাম্ব এটা করেছে, শূন্য মেরেছে। এমনকি যখন রান করতাম তখনো তারা আমাকে ইংরেজ বলে মেনে নিতে চাইতো না।’

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ। খেলার আগে যখন পতাকা সামনে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত বেজে উঠে, তখন অংশগ্রহণকারীরা দেশের প্রতিনিধি হয়ে উঠে। বাইশ গজের খেলায় দেশের জয়-পরাজয় নির্ভর করে কেবল তাদেরই উপর। দর্শকরা তাই ভিনদেশী কাউকে নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেই পারেন। ২০০৫ সালে কেভিন পিটারসেন তার হাতে ইসিবির ক্রেস্টের ট্যাটু করিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের প্রতি আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে।

জোনাথন ট্রট ক্রেইগ কিসওয়েটারের সাথে এক ঘটনার কথা স্মরণ করেন। কিসওয়েটার তাকে বলেন সে যদি আর কখনো দক্ষিণ আফ্রিকান টানে কথা না বলতো তাহলে স্বাছন্দ্যবোধ করতো। আরো সাবলীলভাবে ইংরেজি বলতে পারলে হয়তো সবকিছুর সাথে তার মানিয়ে নেয়া আরো সহজ হতো। কিসওয়েটার তখন সবে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন। ট্র‍ট তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কোথা থেকে এসেছো সেটা জরুরি নয়, বরং কি করতে যাচ্ছো সেটা ভেবে তোমার গর্বিত হওয়া উচিত।’ পরবর্তীতে কিসওয়েটারই ইংল্যান্ডকে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতান।

জোনাথন ট্রট ইংল্যান্ডের হয়ে ১৩টি সেঞ্চুরি করেন, লাম্ব করেন ১৮টি সেঞ্চুরি। অন্যদিকে কেভিন পিটারসেন তো তর্কসাপেক্ষে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান, কেপির ৩২ সেঞ্চুরি অ্যালিস্টার কুক এবং জো রুটের পর ইংল্যান্ডের পক্ষে তৃতীয় সর্বোচ্চ। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা বেশিরভাগ ক্রিকেটারই ছিলেন ব্যাটসম্যান, ইংল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হওয়া ১৯ জনের মাঝে মাত্র পাঁচজন বোলার। মজার ব্যাপার হলো, দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকতে কেপি নিজেও অফস্পিনার ছিলেন, অথচ ইতিহাস তাকে মনে রেখেছে ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্ট্রোকমেকার হিসেবে।

ইংল্যান্ডের হয়ে ৬২ টেস্ট এবং ৭১ ওয়ানডেতে প্রতিনিধিত্ব করা অ্যালান লাম্ব ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, “ইংল্যান্ডের চাইতে দক্ষিণ আফ্রিকায় পিচ অনেক দ্রুতগতির। আমি যখন এখানে আসি, তখন এখানকার স্লো পিচের সাথে মানিয়ে নিতে কিছুদিন সময় লেগেছিল। জোরে বল খেলে অভ্যাস থাকায় পরে আর আমার রান করতে সমস্যা হয়নি।”

তাছাড়া ইংল্যান্ডের ব্যাটারদের সাথে মানসিকতায়ও তফাত ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা ব্যাটারদের। ‘তারা উইকেটে গিয়ে যতবেশি সম্ভব রান করে নিজেদের গড় বাড়াতে চাইতো। কিন্তু আমি ক্রিজে গিয়ে যতক্ষণ থেকেছি দর্শকদের আনন্দ দিতে চেয়েছি, জয়ের জন্য খেলতে চেয়েছি।’ ঠিক এভাবেই স্মৃতিচারণ করেন লাম্ব।

কেবল রবিন স্মিথ নন, তার ভাই ক্রিস স্মিথও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। ভাইয়েরও মতো ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত না হলেও থ্রি লায়ন্সদের হয়ে আট টেস্ট এবং চারটি একদিনের ম্যাচ খেলেন তিনি। তার ভাষায় দক্ষিণ আফ্রিকার রুক্ষ পরিবেশ তাদেরকে মানসিকভাবে আরো শক্ত হতে শিখিয়েছে।

২০১০ বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ড দলের ওপেনার মাইকেল লাম্ব ২০ বছর বয়সে জন্মস্থান জোহানেসবার্গ ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। “ইংল্যান্ডের হয়ে খেলাটা আমার স্বপ্ন ছিল। আমার বাবা যিনি আমার মাঝে এই স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছেন।” নিজের এবং বাবার স্বপ্নপূরণের উদ্দেশ্যেই দেশ ছেড়েছিলেন লাম্ব। উল্লেখ্য যে লাম্বের বাবা রিচার্ড লাম্ব ইয়র্কশায়ারের হয়ে ৩৭৬ ম্যাচ খেলেছিলেন, যদিও জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানোর সৌভাগ্য হয়নি।

বর্ণবাদের কারণে টানা ২২ বছর ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত ছিল প্রোটিয়ারা। বাসিল ডি অলিভেইরার মতো সম্ভাবনাময়ী ক্রিকেটারের সেরা রূপটা দেখতে পায়নি ক্রিকেটবিশ্ব, ৩৩ বছর বয়সে তাই নাম লেখান ইংল্যান্ড জাতীয় দলে। সেই যুগ পার হলেও দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ড আজও আছে সেই প্রস্তরযুগেই।

দুর্নীতি, বর্ণবাদ, কোটাসিস্টেমের কারণে দক্ষিন আফ্রিকা হারিয়েছে তাদের প্রতিভাবান সন্তানদের। উন্নত ভবিষ্যত কিংবা একটুখানি সুযোগের আশায় তারা পাড়ি জমাচ্ছে ভিন্ন দেশে, গায়ে জড়াচ্ছে অন্য দেশের জার্সি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link