স্টিভ ওয়াহ-কলকাতা ও ফলোঅন মিথ

স্টিভ ওয়াহ নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমরা যখন তৃতীয় দিনে বিরতিতে যাই তখনও ভারত ২০ রানে পিছিয়ে, চার উইকেট নেই! আমরা ড্রেসিং রুমে ভাবছিলাম আমরা টানা ১৭তম টেস্ট ম্যাচ জিতলে কিভাবে আনন্দ করবো।’

১১ মার্চ, ২০০০। সেদিন ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন একটা ম্যাচ শুরু হয় যা অনেক রকম মিথই গোড়া-সহ টেনে বের করে আনে মাটি থেকে।

ইডেন গার্ডেনে ভারতের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া। আগের টেস্টে ১০ উইকেটের বড় ব্যবধানে জয়ে সিরিজ জিততে মরিয়া অজিরা। সেটি অবশ্য হয়নি! জয়ের কাছে গিয়েও রাহুল দ্রাবিড় আর ভিভিএস লক্ষ্মণের মহাকাব্যিক জুটিতে ম্যাচের চিত্র পাল্টে গিয়ে রেকর্ড গড়ে জয় পায় ভারত!

টসে জিতে ব্যাট করতে নামে অজিরা। ম্যাথু হেইডেনের ৯৭ আর জাস্টিন ল্যাঙ্গারের ৫৮ রানে বেশ ভালই এগোচ্ছিল অজিরা। ২১৪ রানে অজিদের তখন ২ উইকেট। সেখান থেকেই হরভজন সিংয়ের স্পিন বিষে ধসে পড়ে অজিদের ব্যাটিং লাইন আপ।

২৬৯ রানেই ৮ উইকেট হারিয়ে তখন বিপাকে অজিরা। তবে নবম উইকেটে অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ ও জেসন গিলেস্পির ১৩৩ রানের অনবদ্য জুটি অজিদের ভাগ্য ঘুরিয়ে দেয়। ওয়াহর সেঞ্চুরিতে শেষ পর্যন্ত ৪৪৫ রানে থামে অজিদের ইনিংস। হরভজন সিং একাই নেন ৭ উইকেট।

জবাবে ব্যাট করতে নেমে ম্যাগ্রা, গিলেস্পিদের সামনে মাত্র ১৭১ রানেই গুড়িয়ে যায় ভারত। ভিভিএস লক্ষ্মণ একমাত্র পঞ্চাশোর্ধ ৫৯ রানের ইনিংস খেলেন। প্রথম ইনিংসে ফলো-অনে পড়ে স্বাগতিকরা। ২৭৪ রানে পিছিয়ে থাকায় অজি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ ভারতকে ফলো-অনে রেখে আবারো ব্যাট করানোর সিদ্ধান্ত নেয়! এই সিদ্ধান্তই যেন ইডেন গার্ডেনে পাল্টে দেয় পুরো ম্যাচের হুলিয়া।

২৭৪ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ২৩২ রানে ৪ উইকেট হারায় ভারত। তখনও ইনিংস হার এড়াতে আরো ৪২ রান বাকি। ম্যাচে অজিদের জয় হচ্ছে তাও প্রায় নিশ্চিত।

স্টিভ ওয়াহ নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমরা যখন তৃতীয় দিনে বিরতিতে যাই তখনও ভারত ২০ রানে পিছিয়ে, চার উইকেট নেই! আমরা ড্রেসিং রুমে ভাবছিলাম আমরা টানা ১৭ তম টেস্ট ম্যাচ জিতলে কিভাবে আনন্দ করবো।’

তবে বলাই বাহুল্য যে – সেই উদযাপন আর করা হয়নি অজিদের।

পঞ্চম উইকেটে লক্ষ্মণ ও রাহুল দ্রাবিড়ের ৩৭৬ রানের দাপুটে জুটিতে পুরো ম্যাচই বদলে যায়। চতুর্থ দিন পুরো তিন সেশনই ব্যাট করেন এ দুজন! লক্ষ্মণের ২৮১ ও দ্রাবিড়ের ১৮০ রানের দুর্দান্ত ইনিংসে ৭ উইকেটে ৬৫৭ রানে ইনিংস ঘোষণা করে ভারত।

শেষ দিনে অজিদের লক্ষ্য তখন ৩৮৪ রান। ম্যাচ জয়ের স্বপ্ন ভুলে ড্র করাই তখন যেনো বড় চিন্তা। তবে হয়নি! ওপেনিং জুটিতে ৭৪ রান এলেও হরভজন সিংয়ের ঘূর্ণিতে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে ২১২ রানেই শেষ অজিরা! ম্যাচে ইনিংস ব্যবধানে হারতে বসা ভারত ইডেন গার্ডেনে ইতিহাস সৃষ্টি করে ১৭১ রানের বিশাল জয় তুলে নেয়!

এই হারে অধিনায়ক হিসেবে টানা ১৬ জয়ের ধারা ভেঙে যায় স্টিভ ওয়াহর। তবে ফলো-অন না তুলায় বেশ সমালোচনার শিকার হন তিনি। অবশ্য পাঁচ মাস বাদেই ইংলিশ মাটিতে অ্যাশেজ সিরিজে আবারও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন ওয়াহ।

ওভালে শেষ টেস্টে প্রথম ইনিংসে ২০৯ রানে পিছিয়ে থাকে ইংলিশরা। সেই টেস্টেও ইংলিশদের পুনরায় ব্যাটিংয়ে পাঠান ওয়াহ। অবশ্য ওই টেস্টে ম্যাগ্রা, ওয়ার্নদের কল্যানে ইনিংস ও ২৫ রানে জয় পায় অজিরা। একই বোলিং ইউনিট ইডেন গার্ডেনে দ্রাবিড়-লক্ষ্মনের সামনে ছিল অসহায়।

অবশ্য ওয়াহর ওই রেকর্ডে পরবর্তীতে অধিনায়ক হিসেবে ভাগ বসান রিকি পন্টিংও। তবে ইডেন গার্ডেনের ওই পরাজয় নিয়ে দীর্ঘসময় সমালোচনায় ছিলেন সাবেক এই অজি অধিনায়ক। ভারতের মাটিতে ভারতকে সিরিজ হারানোটা মোটেও সহজসাধ্য ব্যাপার না। ওই সিরিজের পর থেকে ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়া ও ২০১২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাদে ৩৩টি হোম সিরিজের ৩১ টিতেই জয় পেয়েছে ভার‍ত।

১৯৮০ সালের পরে ফলো অনের নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে ব্যাট করা দল যদি প্রথম ইনিংসে কমপক্ষে ২০০ বা তার চেয়ে বেশি রানের লিড পায় তাহলেই প্রতিপক্ষ দলকে ফলো-অন করাতে পারবে। এর আগে অবশ্য এর কোনো বাঁধাধরা নিয়ম ছিলো না।

১৯৭১ সালে মাত্র ১৭০ রানের লিড পেয়েও ভারতীয় অধিনায়ক অজিত ওয়াদেকার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পুনরায় ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান। এর ৩০ বছর পর ২০০১ এর ইডেন গার্ডেনের ম্যাচ পর্যন্ত ৮৫২ ম্যাচে মোট ৮৯ বার ফলো-অন করানো হয়েছে টেস্টে। যা মোট খেলা টেস্টের ১০.৪৪ শতাংশ।

ইডেন গার্ডেনের ওই ঐতিহাসিক ম্যাচের পর পরবর্তীতে ৮৭৬ টেস্টে এই রেশিও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.১৮ শতাংশতে। গেলো ২০ বছরে অজিদের খেলা ২৮৮ টেস্টের ২০টিতেই প্রতিপক্ষকে ফলো-অন করিয়েছে। শতাংশ হিসেবে যা মোট খেলা টেস্টে ৬.৯৪।

তবে ২০০৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ৮১ টেস্টের ৫১টিতেই জয় পায় অজিরা। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ও রিকি পন্টিং এই সময়ে ১৪ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করে মাত্র চারবার প্রতিপক্ষকে ফলো-অন করায়! দু’জনই অবশ্যই ইডেন গার্ডেনের সেই দুর্বিষহ স্মৃতি থেকে শিক্ষা নিয়েছে।

এর প্রভাবও দেখা যায় ২০০৪ এর ভার‍ত সফরে। সেখানে ব্যাঙ্গালুরু ও নাগপুর দুই টেস্টেই ফলো-অনে পড়ে ভারত। তবে সেটি উঠিয়ে দিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে বড় লক্ষ্যমাত্রা দাঁড় করায় অজিরা। গিলক্রিস্টের নেতৃত্বে সেবার ভারতের মাটিতে সিরিজ জিতে অজিরা।

অবশ্য ২০০১ এর সিরিজে হরভজনের দুর্দান্ত বোলিং পারফরম্যান্স আর পন্টিং-গিলক্রিস্টদের বাজে পারফরম্যান্স বিবেচনা করেই ভারতকে ফলো-অন করানোর সিদ্ধান্ত নেন ওয়াহ। সেবার হরভজন সিংয়ের সামনে প্রতিরোধই গড়তে পারছিলেননা গিলক্রিস্ট-পন্টিংরা। অবশ্য প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন গিলক্রিস্ট।

ইডেন গার্ডেনে এটি ছিল টেস্ট ইতিহাসের তৃতীয় ও ভারতের জন্য প্রথম ম্যাচ – যেখানে ফলো-অনে পড়ার পরেও ফলোঅনে থাকা দল ম্যাচ জিতে নেয়। স্টিভ ওয়াহ নিশ্চয়ই ভাবেননি, তাদের বিপক্ষে ক্রিকেটের বহুল প্রচলিত মিথটা ভেঙে গুড়িয়ে যাবে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...