ম্যাচ জেতানো ‘মা’

এ তো এক স্বপ্ন যাত্রা! এ তো এক সুখের ভ্রম! প্রথমবারের মত ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলতে নিউজিল্যান্ডে রয়েছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। প্রথমবারে হয়ত প্রত্যাশা ছিল অন্তত কিছু ভাল খেলা উপহার দিবে বাংলার বাঘিনীরা। তাঁরা তাই করলেন। অন্তত কিছু ভাল নয়, পুরো দস্তুর এক ভাল ম্যাচ উপহার দিয়েছেন সালমা খাতুন, জাহারানা আলমরা।

প্রথম দফা বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে দূর্দান্ত এক জয় তুলে নিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। এও কি ভেবেছিল কেউ! তবু তা হয়েছে বাস্তব। বাংলার মেয়েরা পাকিস্তানের মেয়েদেরকে হারিয়ে দিয়েছিল নয় রানে। দারুণ সে জয়ের পর চাঙ্গা থাকা দল মুখোমুখি হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। তবে সদ্যই মা হওয়া আরেক ক্যারিবিয়ান বাঘিনী বাংলাদেশের জয়ের পথে হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাঁধা।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাউন্ট মঙ্গুনাইতে নিজেদের চতুর্থ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল নিগার সুলতানার দল। টসে জিতে বল করার সিদ্ধান্ত নেন অধিনায়ক নিগার। তাঁর সেই সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সম্মান দেখিয়ে দূর্দান্ত বোলিং করেন বাংলাদেশের বোলাররা। যার সুবাদে মাত্র ১৪০ রানে নয় থমকে যায় ক্যারিবিয়ান মেয়েদের ইনিংস।

নয়টি উইকেট নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেন জাহানারা, সালমা, নাহিদা খাতুনরা। সহজ টার্গেট। আরও একটি জয়ের হাতছানি। সেদিকে হাটছিলও বাংলার মেয়েরা। তবে মাঝে এসে বাঁধ সাঁধেন অ্যাফি ফ্লেচার। ক্যারিবিয়ার এই লেগব্রেক বোলার একটানা বল করে তাঁর কোটা পূরণ করেছেন। তবে এর মাঝে তিনি বাংলাদেশের মিডল অর্ডারে ধ্বস নামিয়ে দিয়েছেন।

বাংলাদেশ শুরুর দিকে দুই উইকেট হারালেও নিগার সুলতানা আর ফারজানা হক জুঁটি বেঁধে প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দেন। তবে নিগার-ফারজানা জুঁটিকে আর বেশিদূর এগোতে দেননি ফ্লেচার। ব্যক্তিগত ষষ্ঠ ওভারে বোল্ড আউট করে ফারজানাকে সাজঘরে ফেরান ফ্লেচার। সেই শুরু। এরপর তিনি টানা বল করে যান। মাঝে এক ওভারে রুমানা আহমেদ ও ঋতু মণির উইকেট তুলে নেন।

বাংলাদেশের ব্যাটিং স্তম্ভে সজোরেই আঘাতটা করেন ফ্লেচার। অথচ সম্প্রতি তিনি ক্রিকেটে ফিরেছেন বিশাল এক বিরতি শেষে। মাতৃত্বকালীন বিরতিতে ছিলেন তিনি। ছুটি কাটিয়ে, সন্তান জন্মদানের পর তিনি এইতো গেল ফেব্রুয়ারিতে ফেরেন ক্রিকেট মাঠে। ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে নতুন এক মায়া নিয়ে তিনি বাইশ গজে ফিরে আসেন।

বাইশ গজের মায়া তো আর চাইলেই ছেড়ে চলে যাওয়া যায় না। এ মায়া বড্ড প্রখর। এ মায়া পৃথিবীর শক্তিশালী এক চৌম্বক। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলা সিরিজের একটি ম্যাচে তিনি নেমেছিলেন মাঠে। উইকেটের খুব একটা দেখা পাননি। এরপর বিশ্বকাপের গা গরম করার দুই ম্যাচেও ছিলেন তিনি উইকেট শূন্য।

স্বাভাবিকভাবেই টিম ম্যানেজমেন্ট একটু দ্বিধায় পড়ে গেলেন তাঁকে খেলাবেন কিনা। অবশেষে পঞ্চম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম ম্যানেজমেন্ট সিদ্ধান্ত নিল একাদশে খেলবেন অ্যাফি ফ্লেচার। নবাগত শিশু তাঁর জন্যে নিশ্চয়ই নিয়ে এসেছিল নতুন দিনের মন্ত্র। এতকাল যা ছিল আড়ালে। অপেক্ষা ছিল সঠিক সময়ের। বিশ্বকাপের চাইতে ভাল সময় কিংবা মঞ্চ আর কিই বা হতে পারে।

অধিনায়ক স্টেফেইন টেলর তো ফ্লেচারের এমন দূর্দান্ত পারফর্মেন্সে বেশ আনন্দিত। ফ্লেচারের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘এত লম্বা এক বিরতি আর ধকল থেকে ফিরেই সে তাঁর প্রথম (বিশ্বকাপ) ম্যাচে দারুণ খেলেছে। অনুশীলনে সে বেশ কষ্ট করে যাচ্ছিলো। আমি সত্যিই আনন্দিত তাঁর এমন পারফর্মেন্সে।

তবে সময়টা যদি বছর কয়েক আগেও হতো তবে হয়ত এমন সব সংগ্রামী মায়েদের দেখা মিলত না। বাংলাদেশের বিপক্ষে অসাধারণ এক ম্যাচ জয়ের দিনের ম্যাচ সেরা হ্যালি ম্যাথুস তাই মনে করেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে মেয়েদের খেলাধুলায় বেশকিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে। এটা এক চমৎকার বিষয় যে সে(অ্যাফি ফ্লেচার) দল থেকে বের হয়ে মা হয়েছে এবং আবার ফিরে এসে পারফর্ম করছে।’

তবে যদি এই নিশ্চয়তাটুকু না থাকতো যে তিনি আবার ফিরে আসার সুযোগ পাবেন তাহলে হয়ত চিত্রপটটা খানিক ভিন্ন হতে পারত। তবে হ্যালি ম্যাথুস মেয়েদেরকে এই মাতৃত্বকালীন ছুটির পর আবার মাঠে ফেরার সুযোগটাও বেশ প্রসংসা করেছেন। তিনি বলেন, ‘মেয়ে খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন বিরতির পর আবার খেলার ফেরার এই ঘটনা এখন এক নিয়মিত চিত্র। নারী খেলোয়াড়রা জানেন তাঁদেরকে সে স্বাধীনতাটুকু দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সন্তান জন্মের পর আবার ফিরতে পারবেন মাঠে।’

এমন এক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে ক্রমশই। তাইতো এই যে অ্যাফি ফ্লেচার কিংবা বিসমাহ মারুফরা সন্তান জন্মদানের পরও ক্রিকেট মাঠে পারফর্ম করছেন। ‘মা’ তো আজীবন সংগ্রামী এক নারী। মায়েদের সে সংগ্রাম ঘরের চার দেয়াল ছেড়ে প্রতিনিয়ত আলোকিত করছে পুরো পৃথিবী। সে ধারাবাহিকতায় এখন ক্রিড়াঙ্গনও আলোকিত করছেন মায়েরা। ‘মা’য়েদের অগ্রযাত্রা থেমে যাবার নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link