জীবনটাই যেন তাঁর সেলুলয়েডের কল্পকথা

মজার ব্যাপার হল, ফাওয়াদ ফিফটি করলে সেটিকে সেঞ্চুরিতে রূপ না দিয়ে আউট হন না। অন্তত পরিসংখ্যান তাই বলে, ক্যারিয়ারের প্রথম চার ফিফটির সবগুলোকেই পরিণত করেছেন সেঞ্চুরিতে। প্রথম এশীয় হিসেবে এই রেকর্ড গড়েন তিনি।

অফ ফর্মে পড়লে দল থেকে বাদ পড়বেন, ফর্মে ফিরলে যোগ্যতার জানান দিয়ে ফিরবেন জাতীয় দলে – এটাই তো নিয়ম ক্রিকেট দুনিয়ার। কিন্তু তাঁর বেলায় তেমনটা ঘটেনি। তৃতীয় আর চতুর্থ টেস্টে মাঠে নামার মাঝে পেরিয়ে গিয়েছে ১১ বছর। অথচ মাঝের সময়টাতে ছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। তবুও ডাক পাননি, পুরো ক্যারিয়াটাই এগিয়েছে ভাঙা গড়ার মাঝে। তিনি ফাওয়াদ আলম, পাকিস্তানের অদ্ভুত সিস্টেমের আরেক শিকার। 

পাকিস্তানের করাচিতে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ফাওয়াদের। তাঁর বাবা তারিক আলমও ছিলেন পাকিস্তানের দাপুটে ব্যাটসম্যান। ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত মুখ হলেও জাতীয় দলে কখনও সুযোগ পাননি। নিজের সেই আক্ষেপ তিনি মেটাতে চেয়েছেন ছেলে ফাওয়াদকে দিয়ে। ছেলেও হতাশ করেননি তাঁকে, ক্রিকেটই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। নিজের একাগ্রতা আর নিষ্ঠা দিয়ে দ্রুতই জায়গা করে নেন ঘরোয়া ক্রিকেটের দলে। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই অভিষেক হয় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। পাকিস্তানের হয়ে অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপও খেলার সুযোগ পান ফাওয়াদ।

ঘরোয়া ক্রিকেটে অনবদ্য পারফর্ম করে নিজের আগমণী বার্তার জানান দেন ফাওয়াদ। ২০০৬-০৭ মৌসুমে পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটের ব্যক্তিগত পর্যায়ের সমস্ত পুরষ্কার জিতে নেন। ফাইনালের ম্যাচসেরা, টুর্নামেন্ট সেরা, সেরা ব্যাটসম্যান এমনকি সেরা বোলারের খেতাবও জেতেন তিনি। ফলশ্রুতিতে জাতীয় দলে ডাক পেতেও খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। শ্রীলঙ্কা সফরের জন্য ঘোষিত পাকিস্তান দলে ডাক পান ফাওয়াদ। স্বপ্ন পূরণ হয় তারিক আলমের।

সিরিজের শুরুতেই সাদা বলের ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ফাওয়াদের। যদিও অভিষেক ম্যাচটা দুঃস্বপ্নের মতো কাটে, দিলহারা ফার্নান্দোর বলে সাজঘরে ফেরেন রানের খাতা খোলার আগেই। তবে নিজের সেরাটা বোধহয় তুলে রেখেছিলেন টেস্টের জন্য। নিজের অভিষেক টেস্টেই মুরালিধরন, দিলহারাদের সামলে খেলেন ১৬৮ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। অভিষেকে দেশের বাইরে সেঞ্চুরি করা প্রথম পাকিস্তানি ক্রিকেটার তিনি। এরপর ফাওয়াদের সামনে ছিল কেবলই এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর ঘটে আরেক।

কেবল ব্যাট হাতে নয়, বল হাতেও দারুণ কার্যকরী। তাঁর ডানহাতি অফস্পিনে বহুবার সাজঘরে ফেরত পাঠিয়েছেন প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের। এছাড়া পাকিস্তানের বাজে ফিল্ডিংয়ের যে ‘সুখ্যাতি’ সেখানেও দারুণ দক্ষ ফাওয়াদ। অসাধারণ ফিটনেসের সুবাদে বাকিদের চাইতে ক্রিকেট মাঠে অনেক বেশি ক্ষীপ্র তিনি। কিন্তু পরের দুই টেস্টে ব্যর্থ হওয়ায় দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। সবাই ভেবেছিলেন তিনি বছর খানেকের মাঝেই দলে ফিরবেন। সেই অনুপাতে ঘরোয়া ক্রিকেটে রানও করে গিয়েছেন, কিন্তু ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি। 

রানের পর রান করে গিয়েছেন, কিন্তু ভাগ্যবিধাতা ফিরে তাকাননি। মাঝে সম্ভাবনা জাগাতেও আসাদ শফিক, আজাহার আলিদের উত্থানে তা মিলিয়ে গিয়েছে শূন্যেই।ততদিনে কেটে গিয়েছে ১১ বছর। চব্বিশ বছরের সেদিনের ফাওয়াদ আজ ক্যারিয়ারের গোধূলি বেলায়। ঠিক সেই সময়টাতে যেন তাঁর ক্যারিয়ারের পুর্নজন্ম ঘটে। বদলে গিয়েছে ব্যাটিংয়ের স্টান্স, জীবনটাকেও এখন দেখেন অন্যভাবে। ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রায় ৬০ গড়ে করেছেন আট হাজার রান। 

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে ১১ বছর পর দলে ডাক পান ফাওয়াদ। সেই সিরিজে মনে রাখার মতো কিছু করতে না পারলেও যোগ্যতার জানান দেন পরের সিরিজেই। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাউন্ট মঙ্গানুইতে করেন মনে রাখার মত এক সেঞ্চুরি। রানের ফল্গুধারা বজায় রাখেন পরের সিরিজেও, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তুলে নেন পাকিস্তানের মাটিতে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি। মজার ব্যাপার হলো, ফাওয়াদ ফিফটি করলে সেটিকে সেঞ্চুরিতে রূপ না দিয়ে আউট হন না।অন্তত পরিসংখ্যান তাই বলে, ক্যারিয়ারের প্রথম চার ফিফটির সবগুলোকেই পরিণত করেছেন সেঞ্চুরিতে।

এশিয়ার প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে এই রেকর্ড গড়েন তিনি। সেখানেই থেমে থাকেননি, সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন জিম্বাবুয়ে এবং ক্যারিবীয় মুলুকেও। মাত্র ২২ ইনিংসেই তুলে নিয়েছেন পাঁচ সেঞ্চুরি, তাঁর চেয়ে কম ম্যাচে এই মাইল ফলক ছুঁতে পারেননি এশিয়ার কোন ব্যাটসম্যান। তাঁর মত অসাধারণ ব্যাটসম্যান চূড়ান্ত ফর্মে থাকা অবস্থায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারেননি নির্বাচকদের অবহেলায়, এটা ভাবলেই অজানা বেদনায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। ১৯ টেস্ট খেলে ৩৮.৮৮ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ১০১১ রান। এখানেই থেমে যেতে হল!

তবে জাতীয় দল থেকে বাইরে থাকার সময়টাতে কেবল ঘরোয়া ক্রিকেটে মেতে থাকেননি ফাওয়াদ। পাকিস্তানের দুইটি ওয়েব সিরিজেও অভিনয় করেন। অবশ্য হার্শা ভোগলে ফাওয়াদের জীবনটাকেই তুলনা করেছেন চলচ্চিত্রের সাথে। আসলে ফাওয়াদের জীবনটা তো সিনেমাই, সারাজীবন ধরে অবহেলায় শিকার হয়ে আসা ফাওয়াদ জীবনের শেষবেলায় নায়ক হয়ে সবকিছু ফিরিয়ে দিচ্ছেন সুদে-আসলে। বাড়িয়ে দিচ্ছেন ক্রিকেটপ্রেমীদের আফসোস, ইশ! আর ক’টা দিন আগে যদি সুযোগ পেতেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...