শুধু গোলই যদি বিচারের মাপকাঠি হয়, তবে ইতিহাসে জার্ড মুলারকে শ্রেষ্ঠদের কাতারেই রাখতে হবে। বিশ্বকাপের এক সময়ের সর্বোচ্চ গোল, এক মৌসুমের সর্বোচ্চ গোল; এই রেকর্ডগুলো তার কিছুদিন আগেও টিকে ছিল।
জার্ড মুলার; বিশ্বকাপের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার। স্কিল এবং গোল করার এক অনন্য ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। আমরা যারা ফুটবলের স্কিল দেখতে ভালোবাসি তাদের জন্য রয়েছেন রোনালদিনহো এবং ইয়োহান ক্রুইফের মত ফুটবলার।
জার্ড মুলারের ঠিক সংজ্ঞাটা হলো, যিনি কিনা শুধু বলকে জালের ভিতরে ঢুকাতে ভালোবাসেন। সাথে জার্মান ফুটবলে কিছু অবিস্মরণীয় সাফল্য এনে দিয়েছেন। জার্ড মুলার মূলত খ্যাতি পেয়েছেন তাঁর গোল করার অসাধারণ ক্ষমতার কারণে। তাঁকে বলা হত ‘ডার বোম্বার’ বলে। গোল করার অসাধারণ ক্ষমতার জন্য তাঁকে এই এই নামকরণ করা হয়েছে।
জার্ড মুলার আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেলেছেন পশ্চিম জার্মানির হয়ে। পশ্চিম জার্মানির হয়ে ৬২ ম্যাচে করেছেন ৬৮ গোল। এছাড়াও ক্লাব ক্যারিয়ারে খেলেছেন জার্মানির শীর্ষ ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখে। বায়ার্ন মিউনিখে কাটিয়েছেন ১৫টি মৌসুম। ১৫ মৌসুমে বুন্দেসলিগায় খেলেছেন ৪২৭ ম্যাচ এবং গোল করেছেন ৩৬৫ গোল। এছাড়াও ইউরোপিয়ান ক্লাব টুর্নামেন্টে ৭৪ ম্যাচে গোল করেছেন ৬৬ গোল। অনেক কম ম্যাচ খেলার পরও আন্তর্জাতিক ফুটবলে ১৯তম সর্বোচ্চ গোল তাঁর। ম্যাচ এবং গোলের অনুপাতে এই অবস্থান তৃতীয়।
গোল করার কথার বাইরে যখন কোনো প্রশ্ন আসে তখন অনেকেই গার্ড মুলারকে একটু পিছনেই রাখবেন। অন্যান্য অনেক কিংবদন্তী ফুটবলারের থেকে একটুখানি পিছিয়ে ছিলেন তিনি।
প্রায় দেড় শতক ইউরোপিয়ান ফুটবলকে মাতিয়ে রেখেছেন তিনি। এই সময়ে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে ভয়ংকর এবং নিয়মিত গোল করা স্ট্রাইকার। এই দেড় দশকে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ৬০৫ ম্যাচে করেছিলেন ৫৬৪ গোল। শুধু গোলই করেননি এই সময়ে বায়ার্নের হয়ে জিতেছেন চারটি বুন্দেসলিগা, চারটি ডিএফবি পোকাল কাপ এবং তিনটি ইউরোপিয়ান কাপের শিরোপা।
জার্ড মুলারের আগে নিয়মিত এত গোল করা স্ট্রাইকার কখনো দেখা যায়নি। জার্ড মুলারের পর এই ইতিহাস আবারো ফুটবল বিশ্ব দেখেছিল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং লিওনেল মেসির দ্বৈরথের মাধ্যমে।
জার্ড মুলারের ক্যারিয়ারের সূচনা তাঁর বাল্যকালের ক্লাব ১৮৬১ নর্ডলিনজেনে। সেখানে প্রথম মৌসুমেই নিজের অস্তিত্বের জানান দেন তিনি। লিগে মাত্র ৩১ ম্যাচেই করেন ৫১ গোল। এই পারফর্ম দেখেই বায়ার্ন মিউনিখ দলে সুযোগ পান জার্ড মুলার।
১৯৬৪–৬৫ মৌসুমে বাল্যকালের ক্লাব ছেড়ে জার্ড মুলার যোগ দেন বায়ার্ণ মিউনিখে। আর এর মাধ্যমেই শুরু হয় বুন্দেসলিগায় বায়ার্নের অপ্রতিরোধ্য থাকার এক দুর্দান্ত গল্প। বায়ার্নে এস প্রথম মৌসুমেই ২৬ ম্যাচে করে ফেলেন ৩৩ গোল।
মুলারের গোল করার অস্বাভাবিক এক ক্ষমতার কারণে বেশ দ্রুতই এগিয়ে যেতে থাকে বায়ার্ন মিউনিখ। ১৯৭০ সালের আগেই জিতে নেন একটি বুন্দেসলিগা শিরোপা, তিনটি ডিএফবি পোকাল কাপ এবং একটি ইউরোপিয়ান শিরোপা।
১৯৬৬ সালে জাতীয় দলে প্রথমবারের মত ডাক পেলেও জাতীয় দলে নিজ নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি তিনি। জাতীয় দলের হয়ে নিজের প্রতিভা দেখানোর সুযোগ পান ১৯৭০ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে। পশ্চিম জার্মানির হয়ে ৬ ম্যাচে করেন ১০ গোল। কিন্তু তারপরও জাতীয় দলকে করতে পারেননি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। সন্তুষ্ট থাকতে হয় তৃতীয় হয়ে। ১০ গোল করে হন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
১৯৭০ সালের বিশ্বকাপের পরও থেমে থাকেননি জার্ড মুলার। দুর্দান্ত খেলতে থাকেন তিনি। ক্লাবের হয়ে ১৯৭০–৭১ মৌসুমে জিতে নেন ডিএফবি পোকাল কাপ। এছাড়াও ১৯৭০ সালে ইংলিশ ফুটবলার বব মুরের সাথে মনোনীত হন ব্যালন ডি অরের জন্য। অবশ্য ব্যালন ডি’অর তিনিই জিতে নেন।
এটা কেবল মাত্র শুরু ছিল জার্ড মুলারের জন্য। এরপর জার্ড মুলার যা করেছেন তা ছিল পুরোপুরি একটি ইতিহাস।
১৯৭১–৭২ মৌসুমে বায়ার্নে হয়ে করেছিলেন ৪০ গোল। প্রতি ম্যাচে এক গোলের বেশি। যা কিনা বুন্দেসলিগা ইতিহাসে রেকর্ড হয়ে আছে। এছাড়াও ১৯৭২ সালে এক ক্যালেন্ডার বছরে ৮২ গোল করার রেকর্ড করেন। ঠিক ৪০ বছর পর ২০১২ সালে জার্ড মুলারের এই রেকর্ড ভাঙেন এই সময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ এই তিন মৌসুমে টানা তিন বার বুন্দেসলিগার ট্রফি জিতেন জার্ড মুলার। শুধু ক্লাবের হয়ে নয়, জাতীয় দলের হয়েও এই সময়ে বেশ দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ৩–০ গোলে হারিয়ে ১৮ বছর পর পশ্চিম জার্মানিকে এনে দেন বড় কোনো শিরোপা। ১৯৭৩–৭৪ সালে বায়ার্ন তাদের ইতিহাসের প্রথম ইউরোপিয়ান শিরোপা জিতে নেয়, জার্ড মুলারের কল্যানে।
এত শিরোপা জেতার পরও জার্ড মুলারের জন্য না জেতার মত শিরোপা ছিল বিশ্বকাপের শিরোপা। ১৯৭৪ বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট ছিল পশ্চিম জার্মানি। শুধু ১৯৭২ সালের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল জেতার কারণে নয়। এই দলে ছিলেন জার্ড মুলার, পল ব্রেইটনার, ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ারের মত তারকা ফুটবলার।
১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডকে ২–১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে নেয় পশ্চিম জার্মানি। এই বিশ্বকাপে ৭ ম্যাচে ৪ গোল করেন জার্ড মুলার। এই চার গোলই ছিল তাঁর দলের মধ্যে সর্বোচ্চ গোল। দুই বিশ্বকাপে মোট ১৪ গোল করে পরিনত হন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা। পরবর্তীতে তারই দেশের মিরোস্লাভ ক্লোসা এই রেকর্ড নিজের করে নেন। এই বিশ্বকাপ জিতে পশ্চিম জার্মানিকে উপহার দেন দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা।
জার্ড মুলার সাত বার বুন্দেসলিগার সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। এছাড়াও দুই বার দর্শকদের ভোটে জার্মানির সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ২০১৫ সাল থেকে ভুগছিলেন আলজাইমার রোগে। নিবিড় পরিচর্যায় ছিলেন সেই সময় থেকেই। সেই লড়াইয়ের ইতি ঘটলো ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট।
আক্রমণ ভাগের ফুটবলার জার্ড মুলার কখনোই স্কিলের দিক থেকে খুব বেশি ভালো ছিলেন না। এছাড়াও গতি, শক্তি এবং শারীরিকভাবে বেশ পিছিয়ে ছিলেন। তবুও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে ডিফেন্ডারদের উপর দিয়ে রোলার কোস্টার চালিয়ে গেছেন তিনি।
যদি আমরা টেকনিক এবং স্কিলের দিক বিবেচনা করি তাহলে জার্ড মুলার বেশ খানিকটা পিছিয়ে থাকা একজন ফুটবলার। তবুও তিনি তাঁর সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলারদের মধ্যে একজন।