ক্রিকেটে বাবা ছেলে, দু জনেরই সর্বোচ্চ স্তরে খেলার ঘটনা নেহায়েৎ কম নয়।
পিটার পোলক, শন পোলক, জিওফ মার্শ, শন মার্শ, মিচেল মার্শ, ক্রিস ব্রড, স্টুয়ার্ট ব্রড, হানিফ মোহাম্মদ, শোয়েব মোহাম্মদের মতো বাবা-ছেলের মতো জুটি ক্রিকেটে আরো আছে। তেমনি এক বাবা-ছেলের জুটি হল সুনিল গাভাস্কার এবং রোহান গাভাস্কার। যদি বাবার মতো ছেলে ওই লেভেলের ক্রিকেটার হতে পারেনি। তবে ছেলের পাশেই বাবার কমেন্ট্রিতে অভিষেক হয়!
এক সাক্ষাৎকারে রোহান বলেন, ‘যদি আমি আমার বাবার মতো ব্যাট করতে পারতাম আমারও ক্যারিয়ার শেষে ১০ হাজার টেস্ট রান এবং ৩৪ টা সেঞ্চুরি থাকত। আমি তার ছেলে না হলে, আমার মধ্যে কখনোই ক্রিকেটীয় প্রতিভা আসত না।’
রোহান তার বাবার মতো ক্যারিয়ারে খুব বড় অর্জন করতে পারেননি। তবে তার প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার দেখলে মনে হবে তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ ভালোই করেছিলেন। তিনি বেশ আক্রমণাত্মক একজন বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান ছিলেন যার ব্যাটিং ছিল বেশ মনোমুগ্ধকর। তিনি বাঁ-হাতি স্পিনারও ছিলেন! বেঙ্গলের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি বেশ কিছু উইকেটও শিকার করেছেন।
১১৭ প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৪৪.১৯ গড়ে ৬৯৩৮ রান করেন রোহান। ১৮ সেঞ্চুরির পাশাপাশি আছে ৩৮টি উইকেটও। লিস্ট এ তে ৩১৫৭ রানের পাশাপাশি আছে ৫৮ উইকেট। তবে জাতীয় দলে তিনি ছিলেন সাদামাটা! মাত্র ১৮.৮৭ গড়ে ১১ ওয়ানডেতে তিনি করেছেন ১৫১ রান।
সুনিল গাভাস্কারের ছেলে হওয়ায় সবাই তার নামেই চিনতো রোহানকে। রোহান জয়বিশ্ব গাভাস্কারের নামকরণ করা হয় তার বাবার তিন প্রিয় ক্রিকেটার রোহান কানহাই, এমএল জয়সিমহা এবং গুনদাপ্পা বিশ্বনাথের নামেই।
১৯৭৬ এর ফেব্রুয়ারি ১৩ থেকে ৫ মার্চ ২০ দিনের বিরতি ছিলো নিউজিল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুরের মাঝে। তবুও সুনিল গাভাস্কারকে বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই) তার পুত্র রোহানের জন্মের সময় ছুটি দেয়নি। রোহান পড়াশোনা করেছে বোম্বে স্কটিশ স্কুল এবং এরপর রামনিরঞ্জন আনন্দিলাল পোদার কলেজ কমার্স এন্ড ইকোনমিকসে।
বাবার উপদেশেই রোহান বেঙ্গলে যান এবং সেখানেই তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৯৫-৯৬ তে ইডেন গার্ডেনে ওড়িশার বিপক্ষে ৪৩ এবং ৫৫ করে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন। এরপর চিপাকে তামিল নাড়ুর বিপক্ষে ৬৯ রানের এক গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন এবং তার অভিষেক প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ইন্দোরে ১০৯ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলেন তিনি।
১৯৯৭-৯৮ সালে আগরতলায় ত্রিপুরার বিপক্ষে ৮০ রানের ইনিংস খেলেন। যেখানে বেঙ্গল ২৬৩ রান করে, জবাবে ১ উইকেটে ১৩৫ রান থাকার পরেও মাত্র ১৮১ রানেই গুড়িয়ে যায় ত্রিপুরা। ২৯৪ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ত্রিপুরা ৮ উইকেটে ১১৫ রান করে যেখানে রোহান ৮ ওভারে ৬ মেইডেন দিয়ে ৩ রানে নেন ৫ উইকেট! যেটি তার প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে একমাত্র ফাইফর।
ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ সাফল্যের সাথেই খেলেছেন রোহান। ইস্ট জোনের হয় তিনি দেওধার ট্রফিতে খেলেন। তার টানা দুর্দান্ত পার্ফরমেন্স তাকে পাকিস্তান সফরে ভারত এ দলের হয়ে সুযোগ করে দেয়। গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে শহিদ আফ্রিদি, আকিব জাভেদদের সামনে ১১৫ রানের হার না মানা ইনিংস খেলেন তিনি। রাহুলের সাথে ষষ্ঠ উইকেটে ২২৭ রানের হার না মানা জুটি গড়েন তিনি।
পরবর্তী মোসুমে রোহান ইডেন গার্ডেনে বিহারের বিপক্ষে ১৯০ রানের এক ইনিংস খেলেন। ৩য় উইকেটে ডেভাঙ গান্ধির সাথে ৩৫৪ রানের এক অসাধারণ জুটি গড়েন। আগরতলায় ত্রিপুরার বিপক্ষে ক্যারিয়ার সেরা ২১২ রানের হার না মানা এক ইনিংস খেলেন তিনি। ৩য় উইকেটে সেখানে শ্রীকান্ত কালায়নির সাথে ৪০৬ রানের জুটি গড়েন তিনি। বেঙ্গলের হয়ে এটি এখনো তৃতীয় সর্বোচ্চ জুটি।
টানা ভালো পারফরম্যান্সে ইন্ডিয়ান বোর্ড প্রেসিডেন্ট একাদশের হয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সুযোগ পেয়ে যান রোহান। হায়দ্রাবাদে ইংল্যান্ড ৩২০ রান করে। জবাবে ৭ উইকেটে ৩৪৭ রান করে ইন্ডিয়ান বোর্ড প্রেসিডেন্ট একাদশ। সেখানে রোহান ২৪ রান করেন এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরেই আবারো নিজের সেরা ছন্দে খেলতে থাকেন।
২০০৩ সালে ভারত এ দলের ইংল্যান্ড সফরে ডাক পান রোহান। ট্রেন্ট ব্রিজে চতুর্থ ইনিংসে ভারতের সামনে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৩৪১ রানের। রোহান যখন ব্যাটিংয়ে নামেন ২০ রানে ছিল ২ উইকেট। সত্যজিৎ পরবের সাথে ১৪৮ ও আম্বাতি রয়ডুর সাথে ১৭২ রানের অপরাজিত জুটিতে ভারতকে জয় এনে দেয় রোহান।
এনকেপি সালভে চ্যালেঞ্জার ট্রফিতে ভারত সিনিয়র দলের বিপক্ষে রোহান ভারত এ দলের হয়ে ৭৯ রানের সর্বোচ্চ ইনিংস খেলেন। সিনিয়র দলে হয়ে সেখানে ছিলেন জহির খান, হরভজন সিং, লক্ষ্মিপতি বালাজি এবং মুরালি কার্তিকের মত বোলাররা। রোহানের দুর্দান্ত ইনিংসে সিনিয়ররা পরাজিত হয় ২৭ রানে। এই ইনিংসে রোহান ডান পান অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে।
গ্যাবায় অজিদের বিপক্ষে ৫ম ওয়ানডেতে ডেব্যু হয় রোহানের। শেষ দিকে ব্যাটিংয়ে নেমে ২ রানে অপরাজিত ছিলেন তিনি। এরপর ম্যাথু হেইডেন ও অ্যান্ড্রু সায়মন্ডসের জুটি যখন শক্তিশালী হয়ে উঠছিল তখন সৌরভ গাঙ্গুলি বল তুলে দেন রোহানের হাতে। ওই ওভারের পঞ্চম বলেই সায়মন্ডসকে ফিরিয়ে নিজের প্রথম ও একমাত্র আন্তর্জাতিক উইকেট শিকার করেন তিনি।
এডিলেডে রোহান ব্যাট হাতে তার জাদু দেখান। মাত্র ৪ রানেই ৩ উইকেট হারায় ভারত। এরপর রাহুল দ্রাবিড় ও লক্ষ্মণের ১৩৩ রানের জুটিতে ঘুরে দাঁড়ায় ভারত। এরপর রোহানের ৬২ বলে ৫৪ রানের ইনিংসে লক্ষ্মণের সাথে আরো ১১৮ রানের জুটি গড়ে! রোহান তার একমাত্র আন্তর্জাতিক ফিফটির দেখা পায়। ৭ উইকেটে ২৮০ রান করে ভারত এবং সেখানে ৩ রানের জয় পায় তাঁরা।
এরপর পাকিস্তান সফরে বাদ পড়েন তিনি এবং নেদারল্যান্ডস এবং ইংল্যান্ড সফরে আবারো দলে ফেরেন। ৩ ম্যাচে মাত্র ৪৮ রান করেন তিনি। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে এজবাস্টনে পাকিস্তানের বিপক্ষে আরেকটি সুযোগ পান রোহান, সেখানেও মাত্র ১৩ রান করেন তিনি এবং ভারত বাদ পড়ে যায়! এরপর আর জাতীয় দলে ডাক পাননি তিনি।
এরপর আর রোহান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে পারেননি। এরপর ঘরোয়াতে বেঙ্গলের হয়ে ওয়াঙখেড়েতে মুম্বাইর বিপক্ষে ১৫৪ এর পর গোয়ালিয়রে সেন্ট্রাল জোনের বিপক্ষে ১০৬ এবং ৮০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন তিনি। কোনো কারণ ছাড়াই ৩৩ বছর বয়সেই সব ধরনের ক্রিকেটকে তিনি বিদায় জানান। সর্বশেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচে তিনি উত্তর প্রদেশের বিপক্ষে ২০ ও ৪ রানের ইনিংস খেলেন।
২০০৭ সালে নিষিদ্ধ ক্রিকেট লিগ আইসিএলে কলকাতা টাইগার্সের হয়ে খেলেন তিনি। এরপর তিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়েও খেলেন।
রোহান তার বাল্যবেলার বান্ধুবি সোয়াতি মনকারকে ২০০৩ সালের এপ্রিলে বিয়ে করেন। কমেন্ট্রি প্যানেলে যাওয়ার আগে রোহান টেলিভিশনে ক্রিকেট এক্সপার্ট হিসেবেও কাজ করেন। ক্রিকেট জীবনের প্রথম ইনিংসে হয়তো বাবার চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিলেন তিনি, কিন্তু ধারা ভাষ্যের ভুবনে তিনি অনেকটাই বাবার পাশাপাশি চলতে পারছেন।