হিংস্র মেজাজের ত্রাস

‘গিলক্রিস্ট’ – চট করে মাথায় ঘুরে গেল উইকেটের পেছনে দাঁড়ানো অজি উইকেটরক্ষক অ্যাডাম গিলক্রিস্টের কথা। তবে স্যার গ্যারি সোবার্স অন্য এক গিলক্রিস্ট সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, ‘আহ! গিলক্রিস্ট! আমি যাদের সাথে খেলেছি তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ক্রিকেটার ছিল ও।’

রয় গিলক্রিস্টের ব্যাপারে এমন কথাই বলেছিলেন স্যার গ্যারি সোবার্স। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে জন্মানো সবচেয়ে গতিবান পেসার হিসেবেই বিবেচিত হতেন রয় গিলক্রিস্ট। তবে জীবনের শুরুর দিকটায় তিনি ছিলেন অবহেলিতদের একজন। ২৮ জুন ১৯৩৪ সালে তিনি জন্মেছিলেন জ্যামাইকায়। চিনি উৎপাদনকারী কোন এক প্রতিষ্ঠানের জন্ম। ছেলেবেলা থেকেই শত বঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে।

রুক্ষ পরিস্থিতি তাঁর শক্তি মত্তাকে করেছিল পরিপক্ক। সে শক্তির প্রতিফলনই তিনি ঘটিয়েছিলেন ক্রিকেটের ময়দানে। খেটে খাওয়া মানুষদের কাতার থেকে তিনি একদিন চলে এলেন ক্রিকেটের মহামঞ্চে। আর প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের আতংকে পরিণত হলেন। নিজের অতিমানবীয় গতিতে ব্যাটারদের প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত করে তুলেছিলেন তিনি। প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটে নিজের ভয়ানক গতির সাথে প্রথম পরিচয় করান ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ব্যাটারদের।

এরপর নিজের ধারাবাহিক মুগ্ধতা ছড়ানো গতি দিয়ে তিনি নজর কাড়েন সে সময়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলের নির্বাচকদের। মাত্র ২২ বছর বয়সেই তিনি সুযোগ পেয়ে যান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। আর সেখানেও নিজের ত্রাসের রজাত্ব অব্যাহত রাখেন রয় গিলক্রিস্ট। পাকিস্তানের সাবেক কিংবদন্তি ক্রিকেটার মোহাম্মদ হানিফকে তো রীতিমত ভয়ের ট্রমায় ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।

১৯৫৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েছিল পাকিস্তান। সেখানেই বিদ্যুৎ গতিতে শট বল করেছিলেন। নিজের জীবন বাঁচানোর তাগিদে হানিফ মোহাম্মদকে ডাক করতে হয়েছিল। অথচ তিনি তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ডাক করে কোন বল ছেড়ে দেননি। বরং তিনি হুক করেছেন, পুল করেছেন। অথবা স্থান পরিবর্তন করে ছেড়ে দিতেন। তবে রয় গিলক্রিস্টের বুলেট গতি তাঁকে ঝুঁকতে বাধ্য করেছিল।

সে স্মৃতি রোমন্থন করে হানিফ মোহাম্মদ বলেছিলেন, ‘আমি কখনোই ডাক করা ব্যাটার ছিলাম না। আমি বলের লাইনের এদিক ওদিক করে শট বল ছেড়ে দিতাম। আমি দেখলাম একটা শটবল খুব দ্রুত গতিতে আমার দিকে ধেয়ে আসছে। আমি অবচেতন মনেই এতখানি নুইয়ে গেলাম যে আমার মাথার আঘাতে বেল (স্ট্যাম্পের) পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সেদিন আমি ৮০ রান করেছিলাম। তবুও সে বলটির কথা মনে করলে এখন আমার মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের শীতলতা বয়ে যায়।’

ঠিক এতটাই ভয়ংকর গতিবান বোলার ছিলেন রয় গিলক্রিস্ট। তবে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা তাঁর থেমে যায় মাত্র ১৩ টেস্টেই। এর পেছনে অবশ্য তৎকালীন অধিনায়ক গেরি অ্যালেক্সান্ডারের সাথে ব্যক্তিগত কোন্দল ছিল অন্যতম কারণ। তবে এর আগেই তিনি গোটা ক্রিকেট পাড়ায় একটা সোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন। ১৯৫৮-৫৯ সময়ের মধ্যে তিনি সফরে গিয়েছিলেন ভারতে।

সেখানেই নিজের সামর্থ্যের প্রমাণই যেন রেখেছিলেন। চার টেস্ট খেলে তিনি বাগিয়ে নিয়েছিলেন ২৬টি উইকেট। ১৬.১১ গড়ে তিনি উইকেট শিকার করেছেন ভারতের মাটিতে। সেখানেই ক্ষান্ত দেননি গিলক্রিস্ট। বিজয় মাঞ্জেকারের হাত ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। এজি ক্রিপাল সিংয়ের পাগড়িতেও আঘাত করেছিলেন রয়। মাত্র পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির এই মানুষটি পুরো ভারতীয় ব্যাটিং লাইন আপের সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণে পরিণত হয়েছিলেন সেবারের যাত্রায়।

অধিকাংশ ক্যারিবিয়ান পেসারদের গড় উচ্চতা ছিল প্রায় ছয় ফুট কিংবা তাঁর বেশি। তবে ৫.৮ ফুটের একটা অতি সাধারণ উচ্চতা নিয়েও যে পরিমাণ গতি উৎপাদন করতেন রয় গিলক্রিস্ট তা ছিল সত্যিই বিস্ময়ের কারণ। তবে এমন বিস্ময় খুব একটা পছন্দ ছিল না অ্যালেক্সান্ডারের। বরং গিলক্রিস্টের এমন বিধ্বংসীকর গতির প্রায়শই সমালোচনা করতেন ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক।

তাছাড়া উইকেট পেতে বিলম্ব হলেই গিলক্রিস্ট চটে গিয়ে অনর্থক গতির পসরা সাজিয়ে বসেন। ভারত সফরে তো তিনি বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন স্বরণজিত সিংয়ের সাথে। গিলক্রিস্টকে চটিয়ে দেওয়ার হয়েছিল এবং তিনি কোন কিছু চিন্তা ভাবনা করা ছাড়াই একের পর এক ভয় সৃষ্টি করে এমন বল করতে থাকেন। বিমারও করেন বেশকিছু। শেষমেশ অ্যালেক্সান্ডার তাঁকে দল থেকে বাদ দিতে বাধ্য হয়। আর সেখানেই থেমে যায় রয় গিলক্রিস্টের আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্যারিয়ার।

অথচ সে সফরেই তিনি পেয়েছিলেন নিজের ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগার। ভারতকে লজ্জার এক হারের রেকর্ড গড়ে দেওয়ার কারিগর ছিলেন রয় গিলক্রিস্ট। কলকাতা টেস্টে তিনি দুই ইনিংস মিলিয়ে নিয়েছিলেন নয় উইকেট। আর সে ম্যাচটি ভারত হেরেছিল ইনিংস ও ৩৩৬ রানের বড় ব্যবধানে। সেটাই এখন অবধি ভারতের সর্বোচ্চ ব্যবধানে টেস্ট হারের রেকর্ড। সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে মাত্র ২৪ বছর বয়সেই। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারার কারণে।

এরপর অবশ্য তিনি ক্রিকেট খেলা একেবারেই বন্ধ করে দেননি। ইংল্যান্ডের ক্লাব ক্রিকেটের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেই সাথে তিনি ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটেও খেলেছেন। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে বিভিন্ন দলের হয়ে খেলার পাশাপাশি তিনি রঞ্জি ট্রফিতেও খেলেছিলেন। হায়দ্রাবাদের হয়ে রঞ্জি ট্রফির কোয়ার্টারফাইনাল খেলেছিলেন বাঙলার বিপক্ষে। সে ম্যাচেও নিজের ঝুলিতে পুরেছিলেন নয় খানা উইকেট।

দারুণ সম্ভাবনা নিয়ে তিনি পা রেখেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। তবে তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। নিজের অনুভুতির উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকাই তাঁকে দূরে ঠেলে দেয়। আরও একটি প্রতিভাবান উজ্জ্বল নক্ষত্রপতন হয় ক্রিকেটের মহাকাশ থেকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link