বিশ্বকাপে চাপের মুখে দক্ষিণ আফ্রিকার ভেঙে পড়ার ইতিহাস বেশ পুরনো। নিখাদ ভাগ্যের পরিহাস কিংবা নিজেদের ব্যর্থতা যাই বলা হোক বিশ্বকাপে দুর্দান্ত শুরুর পর জরুরী মূহুর্তে হেরে যাওয়া যেন প্রোটিয়াদের নিয়তি। ব্যতিক্রম ঘটলো না এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও। আগের ম্যাচের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে তবু শক্তিশালী দল বলা চলে। কিন্তু শেষ ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে হেরে এবারের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
অথচ, অস্ট্রেলিয়াতে দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল ফেভারিট দল। প্রথমত অজিদের পিচ অনেকটা আফ্রিকার পিচের মতো, অন্যদিকে প্রোটিয়ারা এসেছে স্মরণকালের সবচেয়ে শক্তিশালী টি-টোয়েন্টি দল নিয়ে। রাবাদা, নর্কিয়া, পার্নেল, এনিগিডিদের নিয়ে গড়া বোলিং লাইনআপ বিশ্বের অন্যতম সেরা। ব্যাটিংয়েও গোলাবারুদের অভাব নেই; ডি কক, মিলার, ক্লাসেনদের পাশাপাশি ছিলেন কলপ্যাক থেকে ফেরা রাইলি রুশোও। সব মিলিয়ে এবারের বিশ্বকাপের শিরোপাটা অনেকেই দেখেছিলেন আফ্রিকার হাতেই।
১৯৯২ বিশ্বকাপে নিয়মের মারপ্যাঁচ কিংবা ৯৯ বিশ্বকাপের পাগলামির তবু অজুহাত আছে। ১৯৯৬ কিংবা ২০১৫ বিশ্বকাপে হয়তো ব্রায়ান লারা কিংবা এক গ্র্যান্ট এলিয়টের ভাল দিনে হারতে হয়েছিল খুব কাছে থেকেও। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে হারের কি ব্যাখ্যা দেবেন। এমনিতেই সুপার টুয়েলভের সবচেয়ে দুর্বল দল ভাবা হচ্ছিল ডাচদের। তাঁরা মূলপর্বে এসেছেও খানিকটা ভাগ্যের সহায়তায়, সেদিন নামিবিয়া আরব আমিরাতের কাছে অঘটনের শিকার না হলে তো মূলপর্বেই আসা হয় না তাঁদের। সেই ডাচরাই কিনা উপহার দিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনের।
অ্যাডিলেডের ম্যাচের আগে কেউ কল্পনাতেও আনতে পারেননি এমনটা ঘটতে পারে। তবু ভাগ্যকে সঙ্গী করে গোটাকয়েক ডাচ সমর্থক এসেছিলেন মাঠে। টস জিতে ফিল্ডিংয়ে নামা প্রোটিয়াদের লক্ষ্য ছিল যত কমে সম্ভব ডাচদের আটকে রাখা যায়। কিন্তু বুড়ো মাইবার্গ, টম কুপার, কলিন অ্যাকারম্যানদের ছোট ছোট কিন্তু কার্যকরী ইনিংসে ১৫৮ রানের লড়াকু সংগ্রহ পায় ডাচরা। তখনও বুঝা যায়নি ম্যাচ জিততে পারে তাঁরা, কারণ দক্ষিণ আফ্রিকার লম্বা লাইনআপের সামনে এ তো এক মামুলী লক্ষ্যমাত্রা।
আফ্রিকানরা জয়ের পথেই ছিল ইনিংসের অর্ধেকেরও বেশি সময়, কিন্তু ১৩তম ওভারে মার্করাম আউট হবার পরেই যেন অদৃশ্য এক চাপ জেঁকে বসে। রান এবং বলের ব্যবধান বেড়ে যাওয়ায় একে একে উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে আসেন ক্লাসেন, মিলাররা। অথচ ১৬০ রানের জবাবে একটু দেখেশুনে খেললেই হত। কিন্তু প্রোটিয়া ব্যাটারদের উপর যেন ভর করেছিল অন্য কেউ, উড়িয়ে মারতে গিয়ে উইকেট বিলিয়েছেন সবাই।
মিলার অবশ্য নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতেই পারেন, রুডলফ ভ্যান ডার মারউইয়ের অবিশ্বাস্য এক ক্যাচের শিকার হয়েছেন তিনি। ফলে নর্কিয়া যখন ম্যাচের শেষ বলটাতে চার মারলেন, তখনো জয় থেকে ১৩ রান দূরে প্রোটিয়ারা। তাতেই আরও একবার অঘটনের শিকার তাঁরা, অন্যদিকে ডাচ ক্রিকেটাররা পেলেন অমরত্ব। অন্তত পাকিস্তানের সমর্থকরা আজন্ম মনে রাখবেন তাঁদের।
বড় টুর্নামেন্টে একবার-দুবার ব্যর্থ হলে সেটাকে অঘটন বলে চালিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হওয়া মানে সেই দলটার নিঃসন্দেহে কোনো সমস্যা রয়েছে। স্কিলে ঘাটতি না থাকলেও মনস্তাত্ত্বিকভাবে নিশ্চয়ই পিছিয়ে থাকেন প্রোটিয়ারা। অন্যথায় বারবার কেন তাঁদের সাথেই এমনটা ঘটবে। নিজেদের এই অপবাদ ঘুচাতে বড় আসরে সাফল্যের বিকল্প নেই। এখন দেখার বিষয় আগামী আসরগুলোতে দক্ষিণ আফ্রিকা তাঁদের এই মানসিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে কিনা।