লেস উলিস, প্যারিসের দক্ষিণের এক ছোট্ট শহর। সে শহরের ছোট্ট এক ফ্ল্যাটে বেঁড়ে উঠছিলেন ফুটবল বিশ্বের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকারদের একজন। হাজার কষ্টের মাঝেও বাবার ছিল পূর্ণ সমর্থন। বাবার হাত ধরেই ছোট্ট থিয়েরি অঁরি খেলতে যেতেন স্থানীয় মাঠে। ক্ষুদ্র অঁরিকে বাবা কোনদিনও বাঁধা দেননি । মুক্ত সবুজ ঘাসে তিনি যেন বেঁড়ে উঠতে থাকেন। আর দশটা শিশুর মতই ফুটবলে লাথি মেরেই দিন যাচ্ছিলো তাঁর।
তবে ১৭ আগস্ট ১৯৭৭ সালে জন্ম নেওয়া অঁরি তাঁর বয়সের বাকি বাচ্চাদের থেকে এগিয়ে ছিলেন। সবচেয়ে বড় সমর্থক বাবা অ্যান্টোইনি ছেলের প্রতিভা যেন আন্দাজ করে ফেলেছিলেন। ছেলের পরিচর্যার প্রয়োজন। তাই স্থানীয় ক্লাবে ভর্তি করে দিলেন। দারিদ্রতা তখনও পিছু ছাড়েনি। বাবার কষ্ট হয়। তবুও ছেলের জন্য তিনি করে গিয়েছেন। ছেলের ফুটবল দীক্ষায় সমর্থন জুগিয়েছেন।
অঁরি তাঁর বাবাকে হতাশ করেননি। নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে আনন্দের অশ্রুজলে ভাসিয়েছেন পরবর্তী জীবনে। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই মোনাকের স্কাউটদের নজর কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন অঁরি। পড়াশুনায় ভীষণরকম দূর্বল থাকলেও ফুটবল প্রতিভার আধার ছিলেন তিনি। মোনাকোর তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ চলতে থাকে অঁরির। এরপর তো এক নতুন রুপকথার যাত্রা শুরু।
১৯ বছর বয়সে ফ্রেঞ্চ ক্লাব মোনাকোর মূল দলে জায়গা করে নেন থিয়েরি অঁরি। প্রতিভাবান ফুটবলার ছিলেন তিনি। মানিয়েও নিতে পারতেন পরিকল্পনা মাফিক। তাইতো মাঠের বা পাশের প্রতিটা পজিশনেই তাঁকে বাজিয়ে দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। তবে না, তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর একজন গোলস্কোরার। সে সত্ত্বাটা সামনে আসতে একটু সময় লাগে। তবে দেরিতে এলেও, তা রঙিন করে দিয়ে গিয়েছে ফুটবল।
ফ্রান্সের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল করা খেলোয়াড় তিনি। ৫১টি গোল তিনি করেছেন ফ্রান্সের হয়ে। তবে সে যাত্রার শুরুটা বোধকরি হয় আর্সেনালে। বহুদিনের কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের সান্নিধ্যে তিনি যেন নিজের পাখাটা মেলেন আরও বেশি চওড়া করে। তাঁর সামর্থ্যের পুরোটাই যেন বেড়িয়ে এলো মোড়ক ছেড়ে। আর্সেনালে এসেই অঁরি নিজের মধ্যে থাকা ‘লিথ্যাল’ স্ট্রাইকারকে পরিচয় করিয়ে দেন বিশ্বের সাথে।
গানার্সদের হয়ে ২২৮ গোল করেছেন তিনি। সবধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে আরও করিয়েছেন ১০৮ খানা গোল। আলোচনার বিষয় তখন যেন তিনিই। এর আগে অবশ্য তিনি ছিলেন ইতালিয়ান আরেক ক্লাব জুভেন্টাসে। কর্তাদের সাথে কোন্দল থেকে ছাড়তে হয়েছিল সে ক্লাব। সেটা মনে হয় তাঁর জীবনের সেরা সিদ্ধান্তই ছিল। নতুবা ফুটবল অন্যতম সেরা স্ট্রাইকারকে পেতে পারত না। সে সম্ভাবনা তো আর একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
গানার্সদের শিবিরে আটটি মৌসুম কাঁটিয়ে তিনি ছুঁটে গিয়েছিলেন নতুন চ্যালেঞ্জের খোঁজে। ইতোমধ্যে ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ জেতাও হয়ে গিয়েছিল থিয়েরি অঁরির। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে তিনি তিনখানা গোলও করেছিলেন। অবসরে যাওয়ার আগে অবধি তিনি চারখানা বিশ্বকাপে গায়ে জড়িয়েছিলেন ফ্রান্স জাতীয় দলের জার্সি। ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে সম্ভাব্য সকল শিরোপা জিতে ফেলেছিলেন অঁরি।
তবে আফসোস একটাই হয়ত থেকে যাবে। ব্যক্তিগত অর্জনের সর্বোচ্চ সম্মাননা ব্যালন ডি’অর কখনো জেতা হয়নি অঁরির। ২০০৩ সালে হয়েছিলেন রানার্সআপ। সেবার চেক প্রজাতন্ত্রের খেলোয়াড় পাভেল নেডভেড বাগিয়ে নিয়েছিলেন ব্যালন ডি’অর শিরোপা। ওই এক আফসোস নিয়েই তিনি বার্সেলোনায় তিন মৌসুম কাঁটিয়ে বেড়িয়ে পড়েন নতুন ঠিকানার খোঁজে।
যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকার এরপর সাক্ষী হয় অঁরির শ্রেষ্ঠত্বের। নিউ ওয়ার্ক রেড বুলস হয় তাঁর নতুন ঠিকানা। সেখানে পাঁচ মৌসুম কাঁটিয়ে নিজের ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানেন থিয়েরি অঁরি। মাঝে অবশ্য অর্ধ মৌসুমের জন্যে গিয়েছিলেন আর্সেনালে, তবে তা ধারে। ক্লাব পর্যায়ে ৩৬০ খানা গোল করে নিজের বুট জোড়া তুলে রাখেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার।
বছর খানেকের বিরতির পর আর্সেনালের যুব দলের হয়ে আবার ফুটবল প্রাঙ্গণে ফেরেন অঁরি। এবার নতুন বেশে। কোচ হিসেবে। নতুন এই যাত্রায় তিনি যেন এখনও শিক্ষানবীশ। তবে একদিন নিশ্চয়ই হবেন তিনি সেরাদের একজন। যেমন করে হয়েছিল একজন ফুটবলার হিসেবে।