হাতে পরা সাদা রিস্ট ব্যান্ড, নাকে মাখা সাদা সানস্ক্রিন আর মাথায় সেটে থাকা সাদা হ্যাট; টেস্ট ক্রিকেটে শেন ওয়ার্নের এই চেহারাটা প্রতীকে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। হলদে জার্সিতে সাদা বলের ক্রিকেটকেও তিনি মাতিয়ে রেখেছিলেন বছরের পর বছর। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে বোধহয় একটু বেশিই ‘টেস্ট’ নিতেন ব্যাটারদের!
তখনকার কিশোরদের মধ্যে শেন ওয়ার্ন মানেই যেন এক উন্মাদনা। ৯০ এর দশকের প্রতাপশালী অস্ট্রেলিয়া দলের অন্যতম কান্ডারি। কেউ যে দলেরই সাপোর্টার হোক না কেন, শেন ওয়ার্নের বোলিং তাকে আলাদা করে টানতই!
আমরা বাঙালিরা ক্রিকেট খেলায় কেন যেন ব্যাটিংটাকেই প্রথম পছন্দের তালিকায় রাখতাম; এখনও রাখি। আমাদের নায়ক হয় তাই সাধারণত ব্যাটসম্যানরাই। আর তারপরেই থাকত কে কত জোরে বল করতে পারে তার একটা প্রতিযোগিতা; মানে পেইস বোলিং। আর নিতান্ত কেউ স্পিন বোলিং করে মানেই অফ স্পিন। এই তালিকায় আপনি লেগস্পিনার খুজে পাবেন না।
কিন্তু সেই চেনা সমীকরণ যেন একটু একটু করে এলোমেলো করে দিতে লাগলেন ওয়ার্ন। কিশোর বয়সে এক একজনের চোখে তখন ওয়ার্নের লেগস্পিন বিস্ময়; সাথে লেগ স্পিনার হওয়ার স্বপ্নও!
ডান হাতের আঙুল দিয়ে বল ঘুরিয়ে শূন্যে তুলে বাম হাতে বল ধরা, সাত-আট পা গুনে গুনে দৌড়, আম্পায়ারের কাছে গিয়ে ছোট্ট একটা লাফ আর বল হাত থেকে ছাড়ার সময় জিহবাটা ঠোঁটের কোনায়- কি অনুসরণ না করত তখনকার কিশোররা! কেউ লেগ স্পিন করে মানেই বোলিং স্টাইলের কোথাও না কোথাও ওয়ার্নের ছাপ।
নব্বইয়ের দশকে তখন প্রায় একই সাথে তিন লেগ স্পিনারের ছড়ি ঘোরানো- অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়ার্ন, পাকিস্তানের মুশতাক আহমেদ আর ভারতের অনিল কুম্বলে। সুযোগ পেলে তাদের বোলিং ‘চোখছাড়া’ করা তখন কঠিন এক কাজ। এই তিনের মধ্যে মুশতাক গুগলি স্পেশালিস্ট আর কুম্বলে টপস্পিন স্পেশালিস্ট হিসেবেই পরিচিত ছিল বেশি।
কিন্তু লেগ স্পিনারের কমপ্লিট প্যাকেজ যেন ওই একজনের মাঝেই দেখা যেত। লেগস্পিন, গুগলি আর ফ্লিপারের এক একটা ওভার তখনকার কিশোর আমি মুগধ হয়ে গিলতাম। আর পরের দিন মাঠে আমিও একটা ভেলকি দেখাব এই স্বপ্ন দেখতাম! ভুরি ভুরি অফ স্পিনারদের মধ্যে লেগ স্পিনের তকমা লাগানোটা সাহসের ব্যাপার বই কি। যেটা শেন ওয়ার্ন করতে পেরেছিলেন। অসংখ্য কিশোর তার দেখাদেখি তখন লেগ স্পিনটাও রপ্ত করতে চাইত।
শতাব্দীর সেরা বল-এর খেতাব পাওয়া বলটার কথা মনে আছে?
১৯৯৩ সালের চার জুন তখনকার জমজমাট অ্যাশেজ সিরিজে ইংল্যান্ডের ডাকসাইটে ব্যাটার মাইক গ্যাটিংকে লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে পিচ করিয়ে অফ স্ট্যাম্পের বেইল উড়িয়ে দেয়া বলটা তো সেসময়ের সদ্য ক্যারিয়ার শুরু করা তরুণ ওয়ার্নের হাত থেকেই ছুটেছিল! শুধু সেই ম্যাচ বা সেই সিরিজের ম্যান অব দ্যা ম্যাচ এবং সিরিজ হয়েই ক্ষান্ত হননি, পুরো ক্রিকেট বিশ্বকেই যেন এই ‘বল অফ দ্য সেঞ্চুরি’ নতুন করে ফিরিয়ে এনেছিল লেগ স্পিনের হারিয়ে যাওয়া জাদুকরী ক্ষমতা!
১৪৫ টেস্টে ৭০৮ উইকেট, ১৯৪ ওডিআইতে ২৯৩ উইকেট আর ৭৩ টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে ৭০ উইকেট এর রেকর্ডধারী শেন ওয়ার্ন। কিন্তু এত রেকর্ড ছাপিয়েও একজন শেন ওয়ার্নের বোলিং শৈলী বিশ্বকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল বহু বছর। পরবর্তী প্রজন্মকে ভাবতে শিখিয়েছিল লেগ স্পিন নিয়ে।
বেস্ট লেগ স্পিনার বা বেস্ট স্পিনারের তালিকায় তো বটেই, সেরাদের সেরা হিসেবেও আপনি উপরের দিকেই থাকবেন। ভালো থাকবেন, মিস্টার জাদুকর।