ক্ষুধার জ্বালায় নামে জ্যোৎস্না

খাবারের টেবিলে একটা মেন্যুই থাকতো প্রতিদিন- রুটি আর দুধ। কিন্তু সেই দুধের সঙ্গেও মেশাতে হতো পানি, বেকারি থেকে রুটি কিনতে হতো বাকিতে। শুধু গরীব না, রীতিমতো নি:স্ব কোন পরিবারের বর্ননা। মাকে দুধের সাথে পানি মেশাতে দেখে সেই পরিবারের ছয় বছর বয়সী সন্তান বুঝে ফেলেছিল তাকে কি করতে হবে।

ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল একদিন ফুটবল খেলবে সে, দূর করবে মায়ের দু:খ। বড় হয়ে কথা রেখেছে ছেলেটা; শুধু ফুটবল খেলেই নি, নিজ দেশ বেলজিয়ামের সেরাদের একজন হয়েছে। পরিবর্তনের এই গল্পটা বেলজিয়ান স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকুর।

১৯৯৩ সালের ২৩ মে বেলজিয়ামের অ্যান্টরাপ শহরে জন্মগ্রহণ করেন রোমেলু লুকাকু। বাবা রজার লুকাকু ছিলেন পেশাদার ফুটবলার, কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে থাকা রজারের পরিবারের আর্থিক অবস্থা একেবারে ভাল ছিল না। এই দরিদ্রতাকে সঙ্গী করেই বাবার দেখাদেখি ছোটবেলা থেকে লুকাকু মেতে উঠেছিলেন ফুটবলের নেশায়। পার্ক কিংবা গলি যেখানে সুযোগ পাওয়া যেত সেখানে খেলা শুরু করে দিতেন তিনি।

শরীরের দিক দিয়ে সমবয়সীদের একটু বড় মনে হতো লুকাকুকে আর তাই প্রায় তার বয়স নিয়ে সন্দেহ হতো অনেকের। ১১ বছর বয়সে যখন স্থানীয় ক্লাব লিয়েরস যুব দলে খেলতেন তখন একদিন অন্য দলের এক অভিভাবক রীতিমতো তাকে মাঠে নামতে বাধা দিল। বয়স কতো, আইডি কার্ড কই, কোথা থেকে এসেছে-এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল রোমেলুকে। গাড়ি ছিল না, তাই দৌড়াতে দৌড়াতেই বাড়ি থেকে আইডি কার্ড এনে তাদের দেখাতে হয়েছিল সেসময়।

বাবাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন কত বছর বয়সে তিনি প্রথম পেশাদার চুক্তি করেছেন, বাবা উত্তর দিয়েছিল ষোল বছর। সেই থেকে রোমেলু’র লক্ষ্য ছিল ষোল বছরেই তিনিও পেশাদার ফুটবলে নাম লিখবেন। অবশ্য পুরোপুরি লক্ষ্য পূরন করতে পারেননি তিনি। এগারো দিন দেরি হয়েছিল, ষোল বছর এগারো দিনের দিন বেলজিয়ামের প্রথম স্তরের ক্লাব আন্ডারলেখটের হয়ে চুক্তি করেন লুকাকু।

আন্ডারলেখট অনূর্ধ্ব-১৯ দল আর সিনিয়র দল মিলিয়ে ১০০টি ম্যাচ খেলেছিলেন রোমেলু লুকাকু। এসময় ৪২ টি গোল করেছিলেন, পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়েও করিয়েছিলেন ১৮টি গোল। শুধু গোলসংখ্যায় নয়, ঠাণ্ডা মাথার ফিনিশিং, ক্ষিপ্রতা আর শারীরিক সক্ষমতা দেখিয়ে ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর নজর কাড়েন রোমেলু লুকাকু।

নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারে এভারটনের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন লুকাকু। ইংলিশ ক্লাবটির হয়ে সর্বমোট ১৬৬ ম্যাচ মাঠে নেমেছিলেন এই স্ট্রাইকার। এবং এই দলের হয়ে ৮৭টি গোল এবং ২৯টি অ্যাসিস্ট করেছেন রোমেলু লুকাকু।

এছাড়া চেলসি এফ.সি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং ইন্টার মিলান এর মত ঐতিহ্যবাহী ইউরোপীয় ফুটবল ক্লাবগুলোর জার্সিও গায়ে জড়িয়েছেন এই বেলজিয়ান ফুটবলার। এর মধ্যে অলরেড হয়ে ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৯৬টি ম্যাচ খেলে ৪২ গোল এবং ১৩টি অ্যাসিস্ট করেছেন তিনি। ইন্টার মিলানের হয়ে এক ম্যাচ কম খেলে করেছেন ৬৪ গোল আর ১৬টি অ্যাসিস্ট। নিজের সবচেয়ে ভাল সময়টা এই ইতালিয়ান দলেই কাটিয়েছেন তিনি।

অন্যদিকে দুই দফায় চেলসি’র হয়ে চুক্তি করেছিলেন লুকাকু। যদিও ব্লুজদের হয়ে দুইবারই প্রত্যাশা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। এখন পর্যন্ত ৫৭টি ম্যাচ খেলে মাত্র ১৫টি গোল করেছেন। লুকাকুর মত স্ট্রাইকারের জন্য সংখ্যাটা অনেক কমই বটে।

বেলজিয়াম জাতীয় দলের হয়ে অবশ্য বরাবরই উজ্জ্বল রোমেলু লুকাকু। ২০১০ সালে অভিষেকের পর থেকে গত একযুগ দেশকে সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে আসছেন তিনি। আন্তজার্তিক ক্যারিয়ারে ১০১ ম্যাচে ৬৮ বার জালের দেখা পেয়েছেন কঙ্গোর বংশদ্ভূত এই খেলোয়াড়।

জাতীয় দলে বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্মের অংশ হয়েও তেমন কিছু জেতা হয়নি রোমেলু লুকাকু’র। সে তুলমায় ক্লাব ক্যারিয়ারে অর্জনের খাতা মোটামুটি সমৃদ্ধ বটে। ইন্টার মিলানের হয়ে ইতালিয়ান সিরি এ জিতেছেন একবার, বেলজিয়ামের ঘরোয়া লিগও জেতা হয়েছে। ফিফা ক্লাব কাপ আর ইংলিশ এফএ কাপের শিরোপার স্বাদও পেয়েছেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ২০২০/২১ মৌসুমে সিরি এ বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি৷ এছাড়া ২০১৪/১৫ মৌসুমে ইউরোপা লিগে গোল্ডেন বুটও রয়েছে লুকাকু’র ক্যাবিনেটে।

ছোটবেলায় মা’কে দেয়া কথা রেখেছেন রোমেলু লুকাকু, পূরণ করেছেন নিজের স্বপ্ন। এখন আর লুকাকু’র ঘরে ইঁদুরের অত্যাচার নেই, মেঝেতে ঘুমাতে হয় না তাকে। ভাল থাকা নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা নেই। সবাই এখন চেনে, আইডি কার্ড হাতে তাই ঘুরতেও হয় না বেলজিয়ান তারকাকে। সবমিলিয়ে নি:স্ব থেকে বিশ্বতারকা হয়ে উঠেছেন রোমেলু লুকাকু যার পুরোটাই সম্ভব হয়েছে প্রচন্ড ইচ্ছেশক্তির জোরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link