১৯৯২ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে ০-২ ফলাফলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় নতুন বছরের দ্বিতীয় দিন সকালে সিডনিতে শুরু হতে চলা তৃতীয় টেস্টের চূড়ান্ত এগারোয় ভারত কোনও স্পেশালিস্ট স্পিনার রাখেনি। রবি শাস্ত্রীকে স্পিনার হিসাবে কেউ ধর্তব্যে রাখতই না তখন।
চতুর্থ পেসারের ভূমিকায় অভিষেক ঘটল সুব্রত ব্যানার্জির। এই টেস্টে সৌরভ গাঙ্গুলি ছিলেন দ্বাদশ ব্যক্তি। হয়ত চার পেসারের কথা মাথায় রেখেই টসে জিতে ফিল্ডিং-এর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। অস্ট্রেলিয়ার দুই ওপেনার ডেভিড বুন আর জিওফ মার্শ জমাট শুরু করেছিল।
ফার্স্ট চেঞ্জ হিসেবে এসে সেট হয়ে যাওয়া জেফ মার্শকে বোল্ড করে অজি শিবিরে প্রথম ধাক্কাটা দিলেন নবাগত সুব্রত ব্যানার্জিই। এরপর জমে যাওয়া মার্ক টেলর ও মার্ক ওয়াহও সুব্রতর বিষাক্ত স্যুইংয়ের হদিশ করতে না পেরে প্যাভিলিয়নের রাস্তা ধরলেন। অভিষেক টেস্টে এভাবে যখন ছন্দ যখন পেয়ে গিয়েছেন দীর্ঘদেহী বঙ্গসন্তান ঠিক তখনই দুর্বোধ্য কারণে তাঁকে আক্রমণ থেকে সরিয়ে নিলেন আজহার।
প্রথম ইনিংসে ১৭০ রানে পিছিয়ে পড়ে ৬ জানুয়ারি সকালে আবার ব্যাট করতে নামা দ্বিতীয় অস্ট্রেলীয় ইনিংসে আর এক ওভারের জন্যও বল হাতে ফিরে এলেন না সেই প্রথম সকালের নায়ক। আসলে মনে হচ্ছিল, আজাহারউদ্দিন আর ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে একটা টেস্ট জেতার চেয়েও জরুরী ছিল সুব্রত ব্যানার্জির ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়া।
এই সফরেই প্রথম টেস্টে ব্রিসবেনে টেস্ট ক্যাপ হাতে পেয়েছিলেন জাভাগাল শ্রীনাথ। পাঁচটি টেস্টেই খেলানো হয়েছিল তাঁকে। অন্যদিকে সুব্রত ব্যানার্জী জীবনের মত টেস্ট স্কোয়াড থেকে বাদ পড়েন অ্যাডিলেডে পরবর্তী টেস্টেই। সিরিজ শেষে দেখা গেল ভারতীয়দের মধ্যে বোলিং গড়ে সবার উপরে নাম রয়েছে সুব্রতর (গড় ১৫.৬৬)। আর সবার তলায় শ্রীনাথের (গড় ৫৫.৩০)।
পরিসংখ্যান অবশ্যই বলে দেয় না সবকিছু। কিন্তু সেই নিরিখে গভীরতর বিশ্লেষণে বসলেই আজ উঠে আসবে আরও কিছু প্রশ্ন। উক্ত সফরের আড়াই দশক পরে আজ পেছন ফিরে তাঁকালে দেখা যাবে টেস্টগুলি অনুষ্ঠিত হয়েছিল যথাক্রমে ব্রিসবেন, মেলবোর্ন, সিডনি, অ্যাডিলেড ও পার্থে। মনে রাখতে হবে, সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডই সমগ্র অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সেই একমাত্র ময়দান যার চরিত্র ভারতের পক্ষে কিছুটা হলেও অনুকূল।
সিডনি গ্রাউন্ড বাকি মাঠগুলোর মত অতো ফাস্ট নয়। স্পিনারেরাও সাহায্য পায়। আজহার সেখানেই সুব্রতর অভিষেক ঘটিয়ে ভেবেছিলেন চিরতরে বাদ দেওয়ার রাস্তা পরিস্কার করবেন। কিন্তু দুর্দান্ত স্যুইং বোলিং করে আজহারের ক্যালকুলেশন গড়বড় করে দেন তিনি। এরপরে সুব্রতকে জোর করে সরানো ছাড়া আর দ্বিতীয় পথ খোলা ছিল না। অ্যাডিলেডে পরবর্তী টেস্টে তো বটেই, এমনকি পার্থের উইকেটেও চূড়ান্ত একাদশে দলে ঢুকলেন আজহারের পছন্দের ভেঙ্কটপতি রাজু! বারো জনের দলেও জায়গা হল না সুব্রতর!
দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে এলেন প্রবীণ আমরে! পার্থের মত ভেনুতে জায়গা পেলেন না সুব্রত ব্যানার্জী। এর মূল কারন ভাল বোলিং বা খারাপ বোলিংটাতো ম্যাটারই ছিল না। উনি তো আজাহার বা সিলেক্টদের রাডারেই কখনও ছিলেন না যে ওনাকে ব্যাকআপ দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের স্বার্থে বড় বোলার বানানো হবে। শক্তিশালী কর্নাটক লবির প্রোজেক্ট করা মগজহীন, বৈচিত্রহীন জাভাগাল শ্রীনাথের পথ নিষ্কন্টক করার জন্য বলি দেওয়া হল সুব্রত ব্যানার্জিকে।
পরবর্তী অধ্যায় আরও নগ্ন লির্লজ্জতায় মোড়া।
বাঙালি পেসারের জীবনে বঞ্চনার ইতিবৃত্ত এখানেই শেষ হল না বরং শুরু হল। মহম্মদ আজহারউদ্দিন যে তাঁকে পছন্দ করেন না সেই সত্যটুকু ততদিনে স্রেফ ওপেন সিক্রেট। ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে ছিল ভারতের পর পর দু’টি বিদেশ সফর। অক্টোবরে সদ্য টেস্ট-কৌলীন্য পাওয়া জিম্বাবুয়ের সঙ্গে হারারেতে একমাত্র টেস্ট। এবং তারপরেই দীর্ঘ একুশ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে ক্রিকেটের মূলস্রোতে ফিরে আসা দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি অবধি বিস্তৃত ভারতের চার টেস্টের পূর্ণাঙ্গ সিরিজ। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসেই সেই প্রথম আফ্রিকা সফর।
দেওধর ট্রফির ফাইনালে ব্যাটে বলে ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্সের দৌলতে ষোলো জনের ভারতীয় দলের টিকিট জোগাড় করে ফেললেন সুব্রত। সাপের ছুঁচো গেলার মত সুব্রতকে নিতে বাধ্য হল ভারতীয় ক্রিকেট ম্যানেজমেন্ট। এরপর শুরু হলো আজাহারকে সামনে রেখে পর্যাপ্ত সুযোগ না দিয়ে দিয়ে এক সম্ভাবনাময় তরুণকে ক্রমশ আত্মবিশ্বাসহীন হতাশাগ্রস্ত করে তোলার কুৎসিত খেলা। কোনও অর্থেই যাকে বলা চলে না জেন্টলমেনস গেম।
১৫ অক্টোবর জিম্বাবুয়েতে একটি ট্যুর ম্যাচে খেললেন সুব্রত। ২৯ অক্টোবর দক্ষিণ আফ্রিকায় নিকি ওপেনহাইমার একাদশের বিরুদ্ধে খারাপ বোলিং করেননি। ৩১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া কম্বাইনড বোলড একাদশের বিরুদ্ধে চারদিনের খেলায় দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট নিলেন ১৯ ওভারে মাত্র ২৯ রান খরচ করে। কিন্তু পর পর সেই দুই সফরের কোনও টেস্টের চূড়ান্ত একাদশেই আর শিকে ছিঁড়ল না।
দুটো ট্যুরেই সফর শেষে প্রথম শ্রেণির খেলাগুলির গড়ের বিচারে আবার ভারতীয় বোলারদের তালিকায় সবার উপরেই থেকে গেল। কেমন বদমাইশি দেখুন। দু দুটো ফাস্ট উইকেটের বিদেশ সফরে সফরের সেরা পেস বোলারেরই একটাও টেস্টে চূড়ান্ত একাদশে ঠাঁই হল না।
এরপরে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে পরবর্তী এক বছরে উপমহাদেশের মাটিতে পরের পর দশটি টেস্ট ছিল ভারতের। জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে দেশের মাটিতে যথাক্রমে ইংল্যান্ডের সঙ্গে তিনটি ও জিম্বাবুয়ের সঙ্গে একটি টেস্ট। জুলাই-অগাস্টে শ্রীলঙ্কায় তিন টেস্টের সফর। এবং পরবর্তী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ভারতে শ্রীলঙ্কার তিন টেস্টের ফিরতি সফর। দক্ষিণ আফ্রিকায় যেভাবে পেস আক্রমণে সমৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিল দল, উপমহাদেশের মাটিতে স্বভাবতই নিরর্থক ছিল সেই স্কোয়াডকে ধরে রাখার।
ষোলো জনের দল থেকে অবিলম্বে বাদ পড়েন চেতন শর্মা ও সুব্রত ব্যানার্জি। আর থেকে গেলেন জাভাগল শ্রীনাথ, যার প্রথম দশ টেস্টের পারফর্ম ছিলো মাত্র পঁচিশটা উইকেট অর্থাৎ টেস্ট পিছু দুই ইনিংস মিলিয়ে মাত্র দুটো উইকেট। এই শ্রীনাথ সম্পর্কে শহীদ আফ্রিদি বলেছিলেন, ‘এটাকে প্রথম দুই ওভার আচ্ছা করে ধোলাই দিলেই এর কাঁধ ঝুলে যায়। সারা ম্যাচে আর খেই খুঁজে পায় না।’
ভারতের নাগালে থাকা বহু জেতা ম্যাচ ভারতকে হারানোয় জাভাগাল শ্রীনাথের অবদান ভোলার নয়। প্রায় বারো বছর ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট খেলার পরে জীবনের শেষ দশটা ওয়ান ডে তে মনে হয় শিখেছিল যে কিভাবে স্লোয়ার দিতে হয় আর স্লগ ওভারে বোলিং করতে হয়। টেস্টে টেল এন্ডারদের কি করে আউট করতে হয় সেটা আর জীবনে শিখতে পারেনি, যার খেসারত দিতে হয়েছে ভারতকে।
আপোষহীন ধরনের মানুষ ছিলেন সুব্রত ব্যানার্জি। কোনওভাবে অধিনায়ককে চটিয়েছিলেন কিনা তা অবশ্য জানি না।
পরেরদিকে ক্রোনিয়ে গেট কেলেংকারি প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় এবং আজহার ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অন্যতম মুখ হিসাবে উঠে আসায় দলের সবাই আজাহারকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। সবাই বুঝে গিয়েছিল আজাহারের বাদ যাওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। সেই সময়ে আজাহার নিজের ঘনিষ্ঠ লোকেদের কাছে আক্ষেপ করতেন।
পরিচিত সাংবাদিকদের দেখা পেলে বিলাপ করে বলতেন, ‘আমি কী করেছি যাতে এই ব্যবহার পেতে হচ্ছে?’ সাংবাদিকদের মুখে প্রাক্তন অধিনায়কের এই খেদোক্তির কথা জানতে পেরে মন্তব্য করেছিলেন তৎকালীন এক সতির্থ ক্রিকেটার, বলেছিলেন, ‘আমি কী করেছি! তুমি কী করোনি? তোমার জন্য সুব্রত ব্যানার্জির কেরিয়ার নষ্ট হয়ে গিয়েছে।’
সুব্রত ব্যানার্জীর ক্যারিয়ার মাত্র একটা টেস্টেই থামিয়ে দিয়েছিলেন আজহার। আর সেই আজাহারই মাত্র একটা টেস্টের জন্যই নিজের ক্যারিয়ারে একশোটা টেস্ট খেলতে পারলেন না। পোয়েটিক জাস্টিসের এতবড় উদাহরন মনে হয় বিশ্বে খুব কমই আছে।
২০০০-২০০১ ফিক্সিং নিয়ে যখন তোলপাড় হয়ে গেছে গোটা ক্রিকেট দুনিয়া, তখন সুব্রত ব্যানার্জি ব্যানার্জি কোথায় ছিলেন? তিনি তখন ছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। ডেনিস লিলির তত্ত্বাবধানে একদিন শুরু হয়েছিল যাঁর প্রবল সম্ভাবনাময় ক্রিকেট ক্যারিয়ার। অভিষেক টেস্টের সেই সিডনি শহরেই তিনি বাস করছিলেন। লেভেল থ্রি কোচিং-এর পাঠ সম্পূর্ণ করছিলেন নি:শব্দে।
২০০৩-০৪ মৌসুম। সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে চার টেস্টের সফরে টিম ইন্ডিয়া উড়ে গেল অস্ট্রেলিয়ায়। স্টিভ ওয়াহর বিদায়ী টেস্ট সিরিজ ছিল। মারাত্মক হাই প্রোফাইল সিরিজ ছিল। ভারত অস্ট্রেলিয়া সিরিজের চেয়েও স্টিভ-সৌরভ টক্করের লেভেল সেঁটে দেওয়া হয়েছিল।
সেই সফরে শচীন টেন্ডুলকার চুপচাপ গিয়ে হাজির হয়েছিলেন সুব্রত ব্যানার্জির বাড়িতে। সেই এক যুগ আগের অস্ট্রেলিয়া সফরে যখন বঞ্চিত হচ্ছেন সুব্রত, পরবর্তী জিম্বাবুয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও যখন তাঁর উপর চলছে অবহেলা, তখন নেহায়েৎই টিন এজের আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণ শচীন।
কিছুই করতে পারেননি সেদিন অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে নিজের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির ইনিংসে কিছু সময় উইকেটের অপর প্রান্তে সঙ্গ দেওয়া বন্ধু সুব্রতর জন্য। ২০০৩-০৪ সফরের অনেক পরিণত, অনেক প্রতিষ্ঠিত শচীন টেন্ডুলকার সুব্রতকে বোঝালেন। বললেন, ‘কিসের এত রাগ! এত অভিমান বন্ধু! নিজের দেশে ফিরে চলো। অস্ট্রেলিয়া নয়, ভারতকে সার্ভিস দাও।’
পরবর্তী প্রজন্মের ইন্ডিয়ান পেসারদের তৈরি করার দায়িত্ব নাও। টেনে নিয়ে গেলেন পুরনো বন্ধুকে টিম ইন্ডিয়ার নেটে। শোনা যায় সেই সময়ে সুব্রত টিম বাসে উঠতে চাননি, বলেছিলেন, ‘এটা প্রোটোকলের বাইরে। আমি নিজের গাড়িতে যাচ্ছি।’
জবাবে শচীন বলেছিলেন, ‘প্রোটোকল আমি বুঝে নেব। তুমি আমাদের সাথে টিম বাসেই যাবে।’ শচীনের অনুরোধে গোটা একটা দিন নাগাড়ে টিম ইন্ডিয়ার নেটে গিয়ে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের বল করেছিলেন সুব্রত।
খেলোয়াড় জীবনে খুব কাছ থেকে সুব্রত ব্যানার্জীর ওপরে হওয়া অন্যায় দেখেছিলেন শচীন। শচীনের জীবনে সেই হতভাগ্য পেসারের প্রতি ঘটে যাওয়া অবিচার যে কী গভীর রেখাপাত করেছিল সেটা বোঝা যায় প্রথম আইপিএল মৌসুমে রিলায়েন্স গোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে কথা বলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বোলিং পরামর্শদাতা হিসেবে পুরনো বন্ধুকে দেশে ফিরিয়ে আনার বন্দোবস্ত করেন শচীন।
পরবর্তীকালে ঝাড়খণ্ড রঞ্জি দলের পূর্ণ সময়ের কোচ হিসেবে সুব্রত নিযুক্ত হয়েছিলেন। উমেশ যাদব এবং বরুণ অ্যারনকে তৈরী করেছেন। নিজের খেলা একমাত্র টেস্টে টেল এন্ডার হিসাবে নেমে শচীন যাতে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরীটা পেয়ে যান সেইজন্য ব্যাট হাতে আপ্রান লড়াই করেছিলেন। সেখান থেকেই সিংহ হৃদয় সুব্রত ব্যানার্জির খেলোয়াড়ি মানসিকতার পরিচয় পেয়েছিলেন বলেই বলেই নিজের ছেলে অর্জুনকেও পুরনো বন্ধুর কোচিং পাঠশালায় দিয়েই নিশ্চিন্ত আছেন শচীন।
কৃতজ্ঞতা: বাইশ গজের বন্ধু