দ্য প্লাটিনাম গ্লাভস

প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। কিছুদিন আগে স্টেট ব্যাঙ্কে জয়েন করে ট্রেনিং করতে ব্যাঙ্গালোরে গেছি। একদিন আমাদের বলা হোল ব্যাংকের দুই অফিসার আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। তখনও জানি না সেই দুই অফিসারের নাম গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ এবং সৈয়দ কিরমানি। আমরা একই সঙ্গে অবাক এবং উল্লসিত। ক্রিকেটিয় আড্ডায় ঘণ্টা দুয়েক কীভাবে কেটে গেছিল বুঝতেই পারি নি।

ভিশি প্রত্যাশা মতোই অল্প কথার মানুষ। ভদ্র, নম্র। তার ইমেজের সঙ্গে পুরোপুরি ম্যাচ করে গেছিলেন। বরং কিরমানি যে এতটা আমুদে হবেন সেটা কল্পনা করি নি আমরা। বহু মজার মজার গল্প, চুটকি ইত্যাদি শুনিয়েছিলেন। তার মধ্যে বেশ কয়েকটা আমিষ। এবং আমাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নারী সহকর্মী ছিলেন।

অনেক প্রশ্নের মধ্যে আমরা সৈয়দ কিরমানিকে সেই প্রশ্নটাও করেছিলাম– মাঠের শ্রেষ্ঠ সিট থেকে কপিলের ১৭৫ দেখার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে নি:সন্দেহে পাগল হয়ে গেছেন কিরি। আজকে লজ্জা লাগে এটা চিন্তা করে যে সেদিন আমরা কোন প্রশ্ন করি নি কিরির কিপিং নিয়ে।

যে চন্দ্রকে খেলতে গিয়ে ভিভ বলে উঠেছিলেন, ‘এ তো থম্মর (জেফ থমসন) মতো ফাস্ট’, সেই চন্দ্রকে উইকেটের জাস্ট পেছনে দাঁড়িয়ে কীভাবে কিরি সামলাতেন? জানতে চাই নি স্পিন চতুষ্টয়কে সামলানোর অভিজ্ঞতার কথা। অথবা কপিলের আউট স্যুইং ঠিক কতটা বাঁক খেত? কেউই চায় কি? আসলে উইকেট কিপারের কাজটাই এমন। ধন্যবাদহীন! তারা ক্যাচ ফেললে বা স্ট্যাম্পিং মিস করলে তবেই সবার নজরে পড়ে। সবকিছু ঠিকঠাক করলে তাদের কেউ খেয়াল করে না।

আজ কতজন মনে রেখেছেন যে ১৯৮৩’র বিশ্বকাপে কিরমানি শ্রেষ্ঠ উইকেট কিপারের সম্মান লাভ করেছিলেন? এবং যাদের পেরিয়ে তিনি এই পুরস্কার পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিল রডনি মার্শ, ওয়াসিম বারি, জেফ্রি দুজোঁর মতো নাম? আটটি ম্যাচে ১২টি ক্যাচ, দুটি স্ট্যাম্পিং – যথেষ্ট উঁচুদরের পারফর্মেন্স। এবং জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে কপিলের সঙ্গে সঙ্গত দিয়ে ১২৬ রানের পার্টনারশিপ(বিশ্বকাপে নবম উইকেটের পার্টনারশিপের বিশ্বরেকর্ড, এখনও)। এটা না হলে ভারতের স্কোর কিছুতেই ২০০ পেরোয় না। মনে রাখবেন, সেদিন ভারতের জয় কিন্তু মাত্র ৩১ রানে। কেকের ওপর আইসিং – ফাইনালে সাঁধুর বলে প্রায় দ্বিতীয় স্লিপের সামনে ঝাঁপিয়ে ধরা বাক্কাসের ক্যাচ।

এই প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে। সবাই জানে সাঁধুর ইন স্যুইঙ্গারে জাজমেন্ট দিতে গিয়ে বোল্ড হয়েছিলেন গ্রিনিজ। বলটা নাকি সাঁধু আউট স্যুইং করতে গেছিলেন, আন্দাজে ইন স্যুইং হয়ে গেছে। ডাহা মিথ্যে কথা! সাঁধু ইন স্যুইংই করতে গেছিলেন। ইন ফ্যাক্ট, তার আগেও তিনি গ্রিনিজকে ইন স্যুইং দিয়ে আউট করেছিলেন। কিন্তু তাহলে এই কাহিনী কোথা থেকে জন্ম নিল? কিরির উর্বর মস্তিষ্ক থেকে (বাইরেটা নয়, মস্তিষ্কের ভেতরের উর্বরতা)। পরে সাঁধু চেপে ধরেছিলেন কিরমানিকে, তিনি তো কখনও বলেন নি কিরমানি আন্দাজে ক্যাচ ধরে ফেলেছেন।

তাহলে তার ক্ষেত্রে এরকম ফালতু গুজব ছড়ানোর মানে কি? সাঁধুর কাছে ক্ষমা চেয়ে কিরমানি স্বীকার করেছিলেন, গল্পটা আকর্ষণীয় করার জন্যে তাতে এই মশলা দিয়েছিলেন তিনি। সেদিন দেখলাম‘৮৩’ সিনেমার প্রমোশনের সময় রাজদীপ সারদেশাইও সাঁধুকে জিজ্ঞেস করছেন তিনি আসলে কী বল করতে চেয়েছিলেন। রীতিমত বিরক্ত হয়ে সাঁধু উত্তর দেন, বল যখন ইন স্যুইং করেছে, তখন আমি ইন স্যুইংই করতে চেয়েছিলাম।

যাই হোক, আসল কথায় ফিরে আসি। ভারতের চিরশ্রেষ্ঠ উইকেটকিপারের আলোচনায় বেশিরভাগ বোদ্ধার লিস্টেই প্রথম নামটি কিরমানিরই হবে। আমাদের ডাকসাইটে স্পিনারদের যেমন তিনি সামলেছেন তেমনি ভারতের চিরশ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলারের বলেও তিনি কিপ করেছেন। কট কিরমানি বোল্ড কপিলদেব – এই লেখাটি স্কোর বোর্ডে মোট ৫১ বার দেখা গেছে।

ক্রিকেট ইতিহাসের ২২তম সফল বোলার – উইকেট কিপার জুটি এটি। কপিল – কিরির পার্টনারশিপ ভাঙ্গে ১৯৮৬ সালে, তখনও অব্দি নিজের ৪৩৪ এর মধ্যে মাত্র ২৮১ উইকেট নিয়েছেন কপিল। যদি এই জুটি আরও একটু লম্বা হত তাহলে নিঃসন্দেহ তাদের সফলতার ক্রম আরও অনেকটাই ওপরে থাকত।

এবার দুটো ছোট্ট তথ্য দিয়ে শেষ করি। ১৯৮১-৮২ সালের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজের তিনটি টেস্টে একটিও বাই দেন নি কিরমানি। মোট ১৯৬৪ রান স্কোর করেছিল ইংল্যান্ড সেই সিরিজে। এছাড়াও এমন তিনটে ইনিংস আছে যাতে বিপক্ষ দল ৫০০র ওপর রান করেছে অথচ কিরির গ্লাভস থেকে একটাও বাই বেরোয় নি।

এও বেশ কিছুদিন বিশ্বরেকর্ড ছিল। কারা বোলার ছিলেন এই ম্যাচগুলোতে? চন্দ্র, বেদি, প্রসন্ন, মানিন্দার, শিবলাল যাদব থেকে শুরু করে কপিলদেব, মদনলাল, মহিন্দর অমরনাথ, কার্সন ঘাউড়ি পর্যন্ত। এরপর সম্ভবত কিরির দক্ষতা নিয়ে আর কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link