অনন্য এক ক্রিকেট চরিত্র

ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের কাছে শিখে টিখে নেবার জন্য (understudy to Farokh Engineer) ১৯৭১ আর ১৯৭৪ সালে ভারতের প্রাথমিক টিমে জায়গা পেয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা হুসেন কিরমানি। ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপেও ইংল্যান্ডে ‘ওই একই ক্যাপাসিটি’তেই টিমে ছিলেন কিরি। তিনটি ট্যুরেই তাদের রুমমেট করে দেওয়া হয়েছিল এজন্য। ১৯৭১য়ের ৫ বছর পরে ১৯৭৬য়ের নিউজিল্যান্ড সফরে টেস্ট আর ওয়ানডেতে ভারতীয় দলে অভিষেক হয়েছিল কর্ণাটকী উইকেটরক্ষক সৈয়দ কিরমানির।

১৯৭৬ সালে নিউজিল্যান্ড সফরের আগে কিরিকে এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের কাছে কেমন শিখলেন?’ প্রথমে চারিদিকে একটু তাকিয়ে কিরি নিশ্চিত হয়ে নেন যে আশেপাশে ফারুক নেই। তারপরে সুরসিক কিরি খুব ক্যাজুয়ালি মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি শেখার সুযোগ খুব কমই পেয়েছিলাম। কারণ তিনটে ট্যুরেই অধিকাংশ রাতেই ফারুক হোটেলেই ফিরত না। আর সেটা মোটেই শিক্ষণীয় ব্যাপার ছিল না।’

১০ বছরের ছোট্ট আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেট কেরিয়ারে (১৯৭৬-১৯৮৬) ৮৮টি টেস্টে ১২৪ ইনিংসে ২টি শতক আর ১২টি অর্ধশতক সমৃদ্ধ ২৭৫৯ রান করেছিলেন কিরমানি, সর্বোচ্চ টেস্ট স্কোর ছিল ১০২। ১৯টি বল করে ১৩ রান দিয়ে ১টি উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তানের আজিম হাফিজের উইকেট ছিল সেটি। যেটি তিনি তাঁর ১/৯ বোলিং হিসেবওয়ালা ১৯৮৩-৮৪র নাগপুরের তৃতীয় টেস্টের (৫-১০ অক্টোবর ১৯৮৩) দ্বিতীয় ইনিংসে অর্জন করেছিলেন পাকিস্তানের আজিম হাফিজকে বোল্ড আউট করে।টেস্টে উইকেটরক্ষক হিসেবে ১৬০টি ক্যাচ ধরা ছাড়াও ৩৮ বার স্টাম্প আউট করেছিলেন তিনি।

আর ওই ১০ বছরের ছোট্ট আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ক্রিকেট ক্যারিয়ারে (১৯৭৬-১৯৮৬) ৪৯টি ওডিআইতে ৩১টি ইনিংসে সর্বোচ্চ অপরাজিত ৪৮ রানসহ ৩৭৩ রান করেছিলেন তিনি, ২৭টি ক্যাচ নেওয়া ও ৯ বার স্টাম্প আউট করা সমেত।

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ছিল তার অনেক বেশি সাবলীল দাপুটে ক্যারিয়ার।২৭৫ প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৩৮৩ ইনিংসে ১৩টি শতক আর ৩৮টি অর্ধশতক সমৃদ্ধ ৯৬২০ রান করেছিলেন কিরমানি, সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ১৬১। ১৭৫টি বল করে ১২৬ রান দিয়ে একটি উইকেট নিয়েছিলেন তিনি, সেই আজিম হাফিজের উইকেটটি। পাকিস্তানের আজিম হাফিজের উইকেট ছিল সেটি। ২৭৫টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে উইকেটরক্ষক হিসেবে ৩৬৭টি ক্যাচ ধরা ছাড়াও ১১২ বার স্টাম্প আউট করেছিলেন তিনি।

ভারতের জেতা ১৯৮৩র বিশ্বকাপে সেরা উইকেটরক্ষকের নাম ছিল কিরমানি, উইকি যা নথিবদ্ধ করেছে এইভাবে – ‘Kirmani won the award for the best wicket keeper in the 1983 Cricket World Cup, his highlight of which was the catch of Faoud Bacchus that he took in the final against the West Indies. In the first round match against Zimbabwe, he equalled the then record by effecting three catches and two stumpings. Kirmani was a lower order reliable batsman and another example is the unbroken 126 for ninth wicket with Kapil Dev against Zimbabwe in the 1983 World Cup with Kirmani contributing 26 and that partnership proved critical in India being able to continue their run in the tournament।’

টেস্টে ৬৫২ রানের প্রতিপক্ষ ইনিংসে কোন ‘বাই’ না দেওয়ায় সেই তালিকাতে বিশ্বে অষ্টম স্থানে ছিলেন তিনি। টেস্টে ৩৮ বার স্টাম্প আউট করে স্টাম্প আউট করা উইকেট কিপারদের তালিকায় বিশ্বে তৃতীয় স্থানে থাকা (ভারতের এখনো প্রথম) কিরমানি তার উকেটকিপিং দক্ষতার অনেকটাই বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন। টেস্টে এক ইনিংসে ছয়টি ‘ডিসমিসাল’ ওই তালিকায় তাকে ৫ম স্থান দিয়েছে আপাতত।

কিরমানি ছিলেন ‘Hyderabadi born in Chennai, settled in Bangalore’। টেনশনের ধার কাছ দিয়ে না যাওয়া কিরমানির ঘুমের প্রতি আসক্তি ছিল দর্শনীয় ব্যাপার। ‘আইডলস’ বইয়ে সুনীল গাভাস্কার সৈয়দ কিরমানি পর্বের হেডিং করেছিলেন – ‘Keeper of India’s fortunes’। কিরমানির ঘুমের প্রতি আসক্তির কথা প্রসঙ্গে সানি সেখানে লিখেছেন যে টিমের ব্যাটিংয়ের সময় সুযোগ পেলেই ঘুমিয়ে নিতেন চাপ তাড়ানো কিরমানি।

১৯৭১ সালের ইংল্যান্ড সফরে ম্যানেজার রামপ্রকাশ মেহেরা তরুণ কিরমানিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে অ্যালান নটের কিপিং দেখে নিতে পরামর্শ দিয়ে ড্রেসিং রুম ছেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়েন।সহ খেলোয়াড়রা পরে রামপ্রকাশ মেহেরাকে ম্যানেজ করেছিলেন এই বলে যে, কিরমানি সাইট স্ক্রিনের পাশে গেছেন নটের কিপিং দেখতে।১৯৭৯ সালে ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট তাকে নিয়ে উৎসাহ দেখানোটা (ইচ্ছে থাকলেও যাননি শেষ অবধি) তার অনেক ক্ষতি করে দিয়েছিল।

১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপ আর ১৯৭৯ সালের ইংল্যান্ড ট্যুরে বাদ পড়েন। ১৯৭৯ সালের শেষ দিকে টিমে ফিরে এসে কিম হিউজের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মুম্বাইতে নৈশপ্রহরী হিসেবে জীবনের প্রথম টেস্ট শতরান করেছিলেন তিনি। জীবনের দ্বিতীয় টেস্ট শতরান তিনি করেছিলেন মুম্বাইতেই, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৮ নম্বর পজিশনে ব্যাট করতে এসে।

এসবিআই-এর পিআর ম্যানেজার কিরমানি ১৯৮৬ সালে ভারতীয় টেস্ট দল থেকে স্থায়ীভাবে বাদ পড়ার পরে কিছুদিন রেলওয়েজের হয়ে রণজি ট্রফিতে খেলেন। ১৯৯০-৯১ মৌসুমে রঞ্জি ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনালে ইডেনে বাংলার বিরুদ্ধে একমাত্র ইনিংসে ১১২ রান করা ছাড়াও পাঁচটি ক্যাচ নিয়েছিলেন কর্ণাটকের উইকেট রক্ষক, তখন ৪০ বছর বয়স অতিক্রান্ত কিরমানি।

এটি ছিল সেই স্নেহাশিস গাঙ্গুলীর পায়ে চোট নিয়ে অতিমানবিক অপরাজিত শতরানখ্যাত বাংলার কোশেন্টে জেতা ম্যাচ। খেলার বাইরে ‘কাভি আজনাবি থি’ ছাড়াও একটি মালায়ালাম ছায়াছবিতেও অভিনয় করেছেন তিনি। সৈয়দ মুজতবা হুসেন কিরমানির নেমসেক ছিলেন বিশ্বখ্যাত পাকিস্তানী ব্যাটার সৈয়দ জাহির আব্বাস কিরমানি। ভারতের এক অনন্য ক্রিকেট চরিত্র হয়েই রয়ে গেছেন তিনি, আজও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link