টি-টোয়েন্টি ও বাংলাদেশের ওপেনিং ধাঁধা

২০ ওভারের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাগ কোনটি? মোটামুটি ক্রিকেট জানে,বুঝে এমন মানুষ মাত্রই বলে দিতে পারবে পাওয়ার-প্লে এবং ডেথ ওভার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অথাৎ শুরুর ছয় ওভার এবং শেষ চার-পাঁচ ওভার মূলত জয়-পরাজয় নির্ধারণে ভুমিকা রাখে। তার কারণ মাঝের এই ৯-১০ ওভার সব দল মোটামুটি রান তোলে; তেমন ব্যবধান হয় না। কিন্তু পাওয়ার প্লে আর ডেথ ওভারের পারফরম্যান্স মূলত ব্যবধান গড়ে দেয়।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা পাওয়ার প্লে এবং ডেথ ওভারে। আগ্রাসী উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান এবং পারফেক্ট ফিনিশারের অভাব প্রায় প্রতি ম্যাচেই স্পষ্ট হয়ে উঠে। ফলে কাজে লাগানো যায় না পাওয়ার প্লে এর ফিল্ড রেস্ট্রিকশনের সুবিধা, ডেথ ওভারেও প্রতিপক্ষের রান রেটের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তোলা হয়ে পড়ে দু:সাধ্য। ফিনিশিং সমস্যা নিয়ে অনেক কথা হয়, আজ উদ্বোধনী জুটি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

বেশি নয়, বরং গত ছয় মাস থেকে নিয়মিত বাংলাদেশ ক্রিকেট ফলো করা প্রতিটি দর্শকেরই জানা আছে কেমন অস্থিতিশীল হয়ে আছে বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি। পরিসংখ্যানে চোখ রাখলেও সেটা স্পষ্ট। সর্বশেষ ১৩ ম্যাচে অর্থাৎ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে আফগানিস্তান সিরিজ পর্যন্ত ছয়টি ভিন্ন ধরনের জুটি বাংলাদেশের হয়ে ইনিংস শুরু করতে নেমেছে।

আর সর্বশেষ দশ ম্যাচে ভিন্ন ভিন্ন পাঁচটি উদ্বোধনী জুটি ব্যবহার করেছে টিম বাংলাদেশ। সর্ব্বোচ্চ ছয়বার ম্যাচ ওপেন করেছে লিটন-নাঈম জুটি। এছাড়া নাঈম-সাইফ এবং নাইম-মুনিম দুই ম্যাচ ওপেন করেছে। এর বাইরেও লিটন-সৌম্য,নাঈম-সাকিব, নাঈম-শান্ত একবার করে ওপেনিংয়ে জুটি গড়েছে।

অবাক করার মতই ব্যাপার, কোন জুটিই পারেনি বাংলাদেশকে একটি ভাল শুরু এনে দিতে। পাওয়ার প্লে পরিপূর্ণ ফায়দা উসুলও করতে পারেনি কোন ওপেনার। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সর্বোচ্চ ৫.৫ ওভার ব্যাটিং করেছিলো লিটন-নাইম জুটি, যেখানে তারা রান করেছিলো ৪০। আর কোন ম্যাচেই বাংলাদেশকে দারুণ শুরু এনে দিতে পারে নি কোন জুটি। বিনা উইকেটে পাওয়ার-প্লে শেষ করতে পারেনি কখনোই বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের শুরু থেকে আফগানিস্তান সিরিজ পর্যন্ত ওপেনারদের পরিসংখ্যান একবার দেখেই আসা যাক।

প্রথমেই নাইম-লিটন জুটির কথা বলা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি,ছয় ম্যাচ ওপেন করেছে এই দুইজন। ১৪.৬৭ এভারেজে ৮৮ করতে পেরেছে এই যুগল। স্ট্রাইকরেট ৮৫.৪৪! এর বাইরে লিটন-সৌম্য,নাইম-শান্ত এবং নাইম-সাকিব একবার করে ওপেনিংয়ে নেমেছে। তবে এদের কেউই পারেনি ৬ ইকোনমির উপরে রান তুলতে। লিটন-সৌম্যের জুটি মাত্র ৮ রান,নাঈম-শান্ত ৭ রান করতেই হারিয়েছে ওপেনিং জুটি। আর সাকিব-নাঈম জুটিতে ২১ রান আসলেও বল খরচ হয়েছে ২৭ টি। স্ট্রাইক রেট ৭৭.৭৮! আধুনিক টি-টোয়েন্টিতে বড্ড বেমানান।

তবে সবচেয়ে বাজে ওপেনিং জুটি নি:সন্দেহে ছিল নাঈম-সাইফ জুটি। কেন একজন টেস্টের ওপেনারকে হুট করে টি-টোয়েন্টিতে ওপেন করতে নামানো হলে তার সদুত্তর আজ পর্যন্ত নির্বাচক প্যানেল দিতে পারেনি। ২ ম্যাচ ওপেন করতে নেমে তারা মোট ক্রিজে ছিল দুইওভার আর রান তুলেছে মোটে চারটি! সদ্য আফগানিস্তানের বিপক্ষে আগমন ঘটলো নতুন ওপেনার, মুনিম শাহরিয়ারের। ঘরোয়া ক্রিকেটে আক্রমনাত্মক ব্যাটিং করে আলোড়ন তোলা এই ব্যাটসম্যান অবশ্য আফগানিস্তানের দুর্দান্ত বোলিংয়ের বিপক্ষে নিজের খোলস ছেড়ে বেরুতে পারেননি। নাইম-মুনিম জুটি দুই ম্যাচে সর্বমোট ক্রিজে ছিলেন ২৩ বল, রান করেছেন ১৭!

ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের হিসেবে আসলে প্রথমেই নাঈম শেখের পারফরম্যান্স আসবে। ওপেনিং জুটিতে এত পরীক্ষা হলেও নাইম শেখ প্রায় সব ম্যাচেই ওপেনার হিসেবে ছিলেন। সর্বাধিক ১২ ম্যাচ খেলেছেন তিনি, বিশের কাছাকাছি এভারেজে ২৩৯ রান। আপাতদৃষ্টিতে খুব খারাপ মনে হয় না, তবে তাঁর স্ট্রাইক রেট মাত্র ৯৯! কোনভাবেই একজন টি-টোয়েন্টি ওপেনার এই স্ট্রাইক রেট মানা যায় না।

এরপর আসা যাক লিটন দাসের পারফরম্যান্সে। ওপেনার হিসেবে সাত ম্যাচ খেলেছেন বিশ্বকাপের শুরু থেকে। রান করেছেন সব মিলিয়ে ৮৯, এভারেজ ১২.৭১। আর স্ট্রাইক রেট নাঈমের চেয়ে বাজে, মাত্র ৯০! এদের বাইরে সাকিব, সৌম্য, শান্ত একবার করে নামলেও পারেননি ভাল কিছু করতে পারেনি, নিজেদের রানই নিতে পারেননি দুই অঙ্কের ঘরে।

স্ট্রাইক রেটও ৮০ এর নিচেই। অন্যদিকে সাইফ দুই ম্যাচে সুযোগ পেয়ে একবার ডাক মেরেই ফিরেছিলেন; অন্য আরেক ম্যাচে রান করেছেন একটি! অন্যদিকে মুনিম আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুই ম্যাচে ব্যাটিংয়ে নামলেও দর্শকদের প্রত্যাশা মত খেলতে পারেননি।

বর্তমানে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টিতে পাওয়ার প্লে কাজে লাগাতে না পারার অন্যতম কারণ এই অহেতুক ডিফেন্সিভ অ্যাপ্রোচই। ২০২০ সালের অস্ট্রেলিয়া সিরিজ থেকেই বিনা উইকেটে পাওয়ার-প্লে শেষ করতে পারেনি কখনোই বাংলাদেশ দল। রানও করতে পারেনি মানসম্পন্ন ইকোনমিতে। অধিকাংশ ম্যাচেই ৬ এর কম ইকোনমি রেটেই পাওয়ার প্লে শেষ করতে হয়েছিলো।

ওপেনারদের অতিরিক্ত ডট বল খেলা পাশাপাশি দ্রুত উইকেট দিয়ে আসার ফলে যে চাপ সৃষ্টি হয় তা মিডল অর্ডার হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারে কিন্তু আবার ক্লিনিক্যাল ফিনিশারের অভাবে রান শেষপর্যন্ত দেখা যায় ১০০ এর আশেপাশেই থাকে। নতুন ব্যাটসম্যান আসেন, পুরনোদেরও বারবার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু বদলায় না পরিস্থিতি, বারবার ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ।

তারপরও স্বপ্ন দেখি আমরা। ব্যাট হাতে স্বরূপে ফেরা লিটন, আক্রমনাত্মক ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করা মুনিম শাহরিয়ার হয়তো নতুন করে সব কিছু শুরু করবেন। সাবলীলভাবে একটি ইনিংস শুরু করবেন। লিটনের স্ট্রাইক রোটেশন আর মুনিমের পাওয়ার হিট, খুব বেশি চাওয়া নেই; পাওয়ার প্লে-তে চল্লিশ-পঞ্চাশ রান আসুক। বিনা উইকেটে অথবা বড়জোর একটা উইকেটে। এমন স্বপ্ন প্রতি ম্যাচেই দেখি; প্রতিটি ব্যাটসম্যানের উপরই প্রত্যাশা রাখি।

একটা সিরিজ শেষ হয় আবার আরেকটি সিরিজ আসে। স্বপ্নভঙ্গ হয়, তবু স্বপ্ন দেখে যাই আমরা। স্বপ্ন দেখতে বাঁধা কিসের?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link