বাংলাদেশ ক্রিকেটের নাড়ি নক্ষত্র জানেন মারিও ভিল্লাভারায়ন। সাকিব-মাশরাফি-মুশফিকদের স্ট্রেন্থ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘ ছয় বছর। এই লঙ্কান এখন কাজ করেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল)।
তবে, বাংলাদেশের খেলা দেখেন এখনও, সতীর্থদের খোঁজ খবর রাখেন। কলম্বোতে বসে খেলা ৭১-এ এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মুখোমুখি হলেন তিনি। সেখানে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অতিত-বর্তমান ও আধুনিক ক্রিকেটে ফিটনেসের গুরুত্ব-সহ অনেক কিছুই উঠে এল।
এখানে কেমন চলছে? এখন কি করছেন?
– খুব ভালো, খুব ভালো চলছে এখন। এখন শ্রীলঙ্কায় পরিবার নিয়ে সময় কাটাচ্ছি। আইপিএলের পর গত এক মাস ধরে এখানে আছি, তাই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি। এলপিএলে কাজ করবো, পরামর্শক হিসেবে। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটেও কাজ করার কিছু সুযোগ হতে পারে।
আপনার ছেলে তো ২০১৫ সালে জন্ম নিয়েছে?
– হ্যা, ২০১৫ সালে, অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপের ঠিক আগে আমার ছেলে জেমির জন্ম। ও ব্রিসবেনে জন্ম নিয়েছে, এখন তার বয়স ১০ বছর। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ভালই করেছিল, সম্ভবত ও বাংলাদেশের জন্য সৌভাগ্য বয়ে এনেছিল
বাংলাদেশে আপনি লম্বা সময় কাজ করেছে, চান্দিকা হাতুরুসিংহের সঙ্গে ছিলেন। এর পরেও ছিলেন। আপনি কি সেই দিনগুলো মনে করতে পারেন?
– হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশে কাজ করেছি প্রায় ছয় বছর—২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত। ওটা ছিল দারুণ সময়, খুব মজার সময়, অনেক ভালো খেলোয়াড় ছিল, ভালো স্টাফ ছিল, দল একসঙ্গে খেলতো। ভালো সময় ছিল, স্মরণীয় সময়। ওই সময়টা আমাকেও অনেক পরিণত করেছে।
২০১৫ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে, সেই যাত্রাটা কেমন ছিল?
– ২০১৫ বিশ্বকাপ একটা খুবই ইন্টারেস্টিং যাত্রা ছিল। যখন আমরা বাংলাদেশে যোগ দিই, তখন দলটা একটু নিচে নেমে গিয়েছিল ২০১৪ সালে। তাই অনেক পরিবর্তন দরকার ছিল। পরিবর্তন এসেওছিল। এই পরিবর্তনগুলো খেলোয়াড়দের মাধ্যমেই এসেছিল। হ্যাঁ, আমরা ছিলাম, সাহায্য করেছি, পেছন থেকে। কিন্তু পরিবর্তনের মূল নেতৃত্ব খেলোয়াড়রাই দিয়েছে—মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, রিয়াদ – এই সিনিয়র খেলোয়াড়রাই মূল পরিবর্তন এনেছে এবং এরপর তরুণদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে।
সৌভাগ্যবশত আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল, সিনিয়র খেলোয়াড়রা আমাদের কথা শুনেছে, বিশ্বাস করেছে এবং পুরো ব্যাপারটাই পাল্টে ফেলেছে। এটাই ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বড় বিষয়।
এখন সিনিয়র খেলোয়াড়রা আর দলে নেই, কেবল মুশফিক আছে টেস্ট ক্রিকেটে, বাকি সবাই সরে গেছে। এখন তরুণ খেলোয়াড়রা খেলছে। আপনি লিটন, মিরাজ, তাসকিনের সাথেও কাজ করেছেন। এখনকার ট্রানজিশন পিরিয়ডটা আপনি কেমন দেখছেন?
– যেমন ধরুন তাসকিনের কথা যদি বলি। আমরা আসার আগেও সে অন্য ট্রেইনারদের সঙ্গে কাজ করছিল। পুরো ব্যাপারটা সময় নেয়। গত ২–৩ বছরে সে পরিপক্ব হয়েছে। তাই তরুণ ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রেও সময় লাগবে, ধৈর্য লাগবে। এখন ফাস্ট বোলাররা পরিপক্ব হয়েছে—খালেদ, এবাদত, তাসকিন, মুস্তাফিজ—সবাই গত ৬–৭ বছর ধরে আছে।
ব্যাটিং বিভাগে লিটন আছে, শান্ত আছে, মেহেদী মিরাজ আছে। বাকি সবাই তরুণ, কারণ রিয়াদ নেই, মুমিনুল এখনও আছে,
মুশফিক এখন কেবল একটা ফরম্যাট খেলে। তাই তরুণদের সময় লাগবে সামনে আসতে।
ফিটনেস তো এখন এখন বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে একটা বড় বিষয়। যদি আপনি ভালোভাবে ফিট না হন, তাহলে চোট পেতে পারেন, মাঠে পারফর্ম করতে পারবেন না। আপনি কীভাবে সেই সময় খেলোয়াড়দের ম্যানেজ করতেন? কেননা আপনি জানেন, কিছু অলসতা তো ছিল।
– দেখুন, আপনি যেই শব্দটা ব্যবহার করলেন—‘অলস’— আমার মতে, ব্যাপারটা ছিল মানসিকতার পরিবর্তন। আমাদের সময় খেলোয়াড়দের মানসিকতা ফিটনেসের বিষয়ে বদলেছিল। এই কারণেই আমরা পার্থক্য দেখতে পেয়েছিলাম।
তাই এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ব্যাপার। আমি বলবো না তারা অলস ছিল। তারা অলস ছিল না, শুধু ফিটনেস নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ছিল। আমরা কোচিং গ্রুপ হিসেবে সেটা পরিবর্তন করতে পেরেছিলাম।
সেটা কীভাবে সম্ভব হল?
এটা অনেকটা শিক্ষাদানভিত্তিক ছিল। শুধু আমার বিষয়টা নিয়ে খেলোয়াড়দের জ্ঞানভাণ্ডার বাড়াতে চাইতাম। বারবার বোঝানো হত তাঁদের। আমি সবসময় বলি, প্রথম দেড় বছর ছিল সবচেয়ে কঠিন—খেলোয়াড়দের বোঝাতে যে তারা কেন এটা করছে।
এটা শুধু মারিও বললো বলে না, তারা যেন নিজেরা বুঝে কেন এটা দরকার এবং কীভাবে উপকার হবে। সেই বিশ্বাস তৈরি করতে সময় লেগেছে।
বাংলাদেশ ছাড়ার পর আপনি থাইল্যান্ডেও কাজ করেছেন, তামিম ইকবালের সাথে…
– হ্যাঁ, আমি থাইল্যান্ডে এক মাস কাজ করেছি, দারুণ সময় ছিল। এখনও যোগাযোগ আছে। আমি জানি, ও (একজন) সাম্প্রতিক সময়ে কিছু সমস্যায় পড়েছিল, আশা করি সে সুস্থ হয়ে আবার ক্রিকেটে ফিরবে।
এখন বাংলাদেশ দল আছে শ্রীলঙ্কায়, কোনো ক্রিকেটারের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
– হ্যাঁ, কয়েক জনের সাথে দেখা হয়েছে— মুশফিক, মুমিনুল, লিটন আর তাইজুল। কিছুজনকে মিস করেছি।
আপনার মতে খেলোয়াড়রা কি অনেক বেশি ক্রিকেট খেলছে? চোটের পেছনে কোনটা বড় কারণ?
– এটা দুইভাবে হতে পারে। হয়তো তারা খুব কম খেলছে, বা খুব বেশি খেলছে। যদি খুব কম খেলে, বা ডোমেস্টিকে যথেষ্ট বোলিং না করে, তাহলে ম্যাচে গিয়ে ইনজুরি হতে পারে। আবার যদি খুব বেশি খেলে, তাহলে বিশ্রাম দরকার। তাই ব্যালেন্স দরকার।
আপনি কী মনে করেন, অস্ট্রেলিয়া, ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে বড় পার্থক্য কী?
– দেখুন, অস্ট্রেলিয়া বা ভারত ইনজুরি থেকে মুক্ত নয়। তারা চোট পায়, কিন্তু তাদের কাছে ব্যাকআপ খেলোয়াড় থাকে। ইংল্যান্ডও তাই। বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কার সমস্যা হলো ব্যাকআপ নেই। তাই এখন ‘এ’ দল বা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলোয়াড়দের গড়ে তুলতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চোট লাগবেই—তা এড়ানো যাবে না।
খাদ্যাভ্যাস কি এর কারণ?
শুধু খাবার না, এটা ট্রেনিং অভ্যাস, খেলার পরিমাণ—সবকিছুর মিল। কতটুকু খেলা হচ্ছে, কতটুকু বিশ্রাম, সব কিছুর সঠিক ব্যালেন্স দরকার।
আপনি তো ছয় বছর ছিলেন বাংলাদেশে, কিছু বাংলা শিখেছেন?
– (হাসি দিয়ে) অল্প-অল্প
আপনার সবচেয়ে অলস ছিল কে? কাকে আপনি ফাঁকিবাজ বলতেন?
উত্তর: শুরুতে কয়েকজন ছিল, কিন্তু পরে সবাই বদলে গেছে। তাই আমি নাম বলবো না—কারণ তারা সবারই পরিবর্তন হয়েছে। মুশফিক আর রিয়াদ অনেক বেশি পরিবর্তন এনেছে। মাশরাফির কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু সে কঠোর অনুশীলন করতো।
কার সাথে কাজ করা সবচেয়ে বেশি কঠিন ছিল?
– (তামিম) ইকবাল খান। ও বদলেছে, কিন্তু একটু কঠিন ছিল।
আপনার হাতুরাসিংহের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশ থেকে তাঁর বিদায়টা ইতিবাচক ছিল না।
– এখন আর তেমন যোগাযোগ নেই, আমরা আলাদা পথে হেঁটেছি। হাতুরুর বিদায়ের সময় আমি ছিলাম না, তাই মন্তব্য করা ঠিক হবে না।