দিনটি ছিল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচ। ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। ম্যাচটা সৌরভ গাঙ্গুলিরও টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ম্যাচ ছিল, পুরো ভারতজুড়ে দর্শকদের ভেতরে বিষয়টি নিয়ে এক মিশ্র এক প্রতিক্রিয়া চলছিল,কেননা ভারতীয় ক্রিকেট তার কিছুদিন আগেই ফিক্সিং এর কালো ছায়ায় ডুবে ছিল। তাই এই সিরিজটি ভারতীয়দের জন্যও ছিল এক নতুন শুরু।
আমিনুল ইসলাম বুলবুল, বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান: আমাদের জন্য সময়টুকু খুবই উত্তেজনাকর ছিল। কেননা, ওয়ানডে ক্রিকেট সম্পর্কে আমরা জানলেও, টেস্ট ক্রিকেট সম্পর্কে আমাদের খুব সামান্যই ধারণা ছিল। এ কারণেই শুরুর একাদশে আমরা ওয়ানডের মতোই দুই জন পেস বোলার, তিন জন স্পিনার, একজন উইকেটরক্ষক এবং পাঁচ জন স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যান নিয়ে নামি। তাছাড়া এই সফরের মাত্র কয়েকদিন আগেই আমরা ঢাকা এসেছিলাম। এর আগে আমরা আফ্রিকা সফর করি এবং সফরটি খুবই বাজে ছিল যেখানে আমরা নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত আইসিসির নকআউট টূর্নামেন্ট থেকে শুরুতেই বাদ পরে যাই।
অন্যদিকে ভারতীয়রা তাঁদের নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিল।
সুনীল যোশি, ভারতীয় স্পিনার: আমি বলব না যে, ম্যাচটা নিয়ে আমরা খুব বেশি সিরিয়াস ছিলাম, কিন্তু আমরা কয়েকদিন অনুশীলন করেছিলাম। আমি যদি ভুল না করি, তবে ঢাকায় আসার আগে ক্যালকাটাতে (বর্তমান কলকাতা) আমরা দুই দিনের অনুশীলন করেছিলাম।
এক পর্যায়ে শচীন[টেন্ডুলকার] বলেছিল যে, ‘আমাদের আরও ভালভাবে প্রস্তুতি নেয়া উচিত।হতে পারে এটা তাদের(বাংলাদেশের) প্রথম ম্যাচ, কিন্তু আমাদের জিততে হলে অনেক ভালভাবে খেলতে হবে।’
সৌরভ (গাঙ্গুলি) নতুন অধিনায়ক হলেও, খুব সিরিয়াস ছিল। সে বারবার সবাইকে ম্যাচ নিয়ে মনোযোগী হতে বলেছিল। ও চাইছিল তাঁর অধিনায়কত্বের ক্যারিয়ার যেন জয়ের মাধ্যমেই শুরু হয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ম্যাচ শুরুর আগে স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন। দিনটা বাংলাদেশের ইতিহাসে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
নাইমুর রহমান দুর্জয় (তৎকালীন বাংলাদেশ অধিনায়ক): আসলে এটা পুরোই একটি উৎসব ছিল। ম্যাচের আগের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-সহ অন্যান্য ক্রিকেটের মহীরুহরা উপস্থিত ছিলেন। বোর্ডের কর্মকর্তারা যারা আমাদের বরাবরই সমর্থন দিয়েছেন তারা এমনকি যারা দেননি তারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমি দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম, বাংলাদেশ কে ক্রিকেটের পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এটা সত্যিই একটা মহান অনুভূতি ছিল। আমরা আগের বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি ওয়ানডে খেলতাম, কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের পথ চলাতে আমরা একেবারেই নতুন ছিলাম,কিন্তু সত্যি বলতে এটা নিয়ে আমি খুব বেশি চিন্তিত ছিলাম না।
বাংলাদেশ টসে জয়লাভ করে এবং ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয়।
নাইমুর রহমান: আমরা জানতাম যে আমরা অনেক অভিজ্ঞ ব্যাটিং লাইন আপের বিপক্ষে লড়তে নেমেছি, তাই আমাদের পরিকল্পনা ছিল আমরা দু’বারই খুব ভাল ভাবে ব্যাট করব। আমাদের বোলারদের ওপরেও আমরা বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। আমরা আমাদের পরিচিত পরিবেশেই ছিলাম। যদিও তখন আমাদের কোচ সারোয়ার ইমরান ছিলেন কিন্তু এডি বারলোও ছিলেন (আগের বছরই অসুস্থতার জন্য বিশ্রামে যান)। তার উপদেশ আমাদের অনেক সাহায্য করেছিল।
ভারত তাদের ওপেনিং ব্যাটসম্যান শিভ সুন্দর দাস,উইকেটরক্ষক সাবা করিম এবং পেস বোলার জহিরখানের অভিষেক করায়। যার ফলে দুই দল মিলে সর্বমোট ১৪ জন অভিষিক্ত ছিল। শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ বাংলাদেশের হয়ে পেসার জাভাগাল শ্রীনাথের করা প্রথম বলটি মোকাবেলা করেন।
শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ, বাংলাদেশ ওপেনার: আসলে নিজের দেশের হয়ে টেস্টে প্রথম বল মোকাবেলা করার অনুভূতি টা সম্পূর্ণ অন্যরকম, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এটা এমন একটা জিনিস,যা কখনোই কেউ আমার থেকে নিতে পারবে না। আমি আমার টেস্ট জার্সি এবং ক্যাপ ফ্রেমে বাঁধাই করে রেখেছি যাতে আমার বাচ্চারা এগুলা দেখতে পারে। এমনকি আমার মৃত্যুর পরেও, তারা জানবে যে তাদের বাবা কত বড় কাজ করে গিয়েছে।
আমি মেহরাব হোসেন অপির সাথে ক্রিজে যাই এবং অন্য সব বারের মতই স্বাভাবিক ভাবে আমি স্ট্রাইকিং প্রান্তে যাই। সে এতে কিছু মনে করে নাই বরং সে আমাকে খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক করে দেয় ওই পরিস্থিতিতে।
মেহরাব হোসেন, জহির খানের বলে সাবা করিমের কাছে ক্যাচ দেয়ার মাধ্যমে প্রথম উইকেটের পতন ঘটে। সাবা করিম তার আগের বছরে এই মাঠেই এশিয়া কাপের ম্যাচে এক গুরুতর চোখের ইনজুরি থেকে মাত্রই সেরে উঠেছিলেন।
সাবা করিম, ভারতীয় উইকেটরক্ষক: আমার ইনজুরির পরে আমি কিছুদিনের জন্য বিশ্রামে ছিলাম। তখন আমি কলকাতাতেই ছিলাম, সাথে চেষ্টা করছিলাম ক্রিকেটে ফিরতে। অক্টোবরেই মুম্বাইতে টাটা স্পোর্টস ক্লাবের কিছু ম্যাচ হয়েছিল। আসলে ওটা আমার চোখের অবস্থা সম্পর্কে জানার অনেক ভাল একটা সুযোগ ছিল। আমি সেখানে একটা ম্যাচ খেলার সুযোগ পাই। ম্যাচে নামার আগ দিয়ে, আমি শুনতে পাই যে বাংলাদেশ সফরের জন্য আমার নাম তালিকা করা হয়েছে। প্রস্তুতির কথা বললে, চোখের জন্য সেটা খুব কমই হয়েছিল। কিন্তু আমি বাংলাদেশে, অনেক আশা এবং এক্সাইটমেন্ট নিয়ে যাই। এটা আমার জন্য স্বপ্নের মত ছিল।
আমার ইনজুরির আগে আমি মোটামুটিভাবে ওয়ানডে দলে টিকে যাই। উইকেটের পেছনে এবং ব্যাটিংয়ে মোটামুটি ভাল করছিলাম যার ফলে ইনজুরি সত্ত্বেও টেস্ট দলে জায়গা আশা করছিলাম।
খেলার এক ঘন্টার সময়ে মেহরাব হোসেন এর পরে শাহরিয়ার হোসেন দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে প্যাভিলিয়নে ফেরত যান। এর ফলে ক্রিজে বুলবুলের সাথে যোগ দেন হাবিবুল বাশার সুমন।
হাবিবুল বাশার সুমন, বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান: আমার চোখ দিয়ে রীতিমত ধোয়া বেরোচ্ছিল! আমি যেন চোখে জোনাকি দেখছিলাম! আসলেই টেস্ট ক্রিকেট সম্পূর্ণ আলাদা একটা খেলা, তাই না? পাশাপাশি তাঁদের বোলিংও অনেক ভাল ছিল।
আমিনুল ইসলাম: সুমন (হাবিবুল বাশার) এমনভাবে খেলছিল মনে হচ্ছিল যেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ চলছে। ও শ্রীনাথকে ইচ্ছেমতো খেলছিল, আগারকার, মুরালি কার্ত্তিককে সহজেই ড্রাইভ করছিল। ওকে দেখে আমি আত্মবিশ্বাসী হই। কিন্তু ওকে নিয়ে ভয়ও পাচ্ছিলাম, এমনভাবে খেলতে গিয়ে সে আউট না হয়ে যায়। যদিও ওর আত্মবিশ্বাসী ইনিংসের জন্যই আমরা ৪০০ পেরোতে পেরেছিলাম।
বাংলাদেশ লাঞ্চে যায় ৭১-২ স্কোর নিয়ে। হাবিবুল বাশার অপরাজিত থাকেন ৪৪ রানে। বিরতি থেকে ফিরেও সে তার আক্রমণ চালু রাখেন। তার ৭১ রানে ১০ টি চার মারেন।
হাবিবুল বাশার: আমি আমার মত করে খেলেছিলাম। আমাকে কে কি বলেছিল, শুনিনি। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে আমার মত করে খেলতে হবে। আমার মনে হয় এডি বারলো যদি আমাকে অত উপদেশ না দিত তবে আমি সেঞ্চুরি করতে পারতাম। যদিও আমি অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরি করতে পারলে ভাল লাগত, তবে ওই ৭১-এর জন্য আফসোসও করি না। আমি মোটামুটি খুশিই ছিলাম সেই ইনিংসের জন্য।
বাশারের উইকেটের পরে, আমিনুল ইসলাম এক প্রান্ত আগলে ৭০ রানে অপরাজিত থেকে দিনশেষ করেন। টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম দিন শেষে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৩৯-৬।
আমিনুল ইসলাম: আমার মনে আছে, প্রথম দিনের খেলা শেষে আমি যখন রফিক এবং গাঙ্গুলির সাথে লিফটে করে টিম হোটেলে যাচ্ছিলাম, গাঙ্গুলি আমাকে তখন টিজ করছিল। বলছিল, আমি যেন নতুন বল নেয়ার আগেই আমার সব রান করে ফেলি। কারণ সে জানত, আমরা দ্রুতই আউট হয়ে যেতে পারি।
পরদিন সকালে যখন আমি নব্বই এর ঘরে যাই, তখনই সেঞ্চুরির বিষয়ে ভাবি। ৯২-৯৮ করতে আমি কিছুটা সময় নিই। আমি কাছে গিয়ে সেঞ্চুরি মিস করতে চাই নি। সেই সময় পাইলট আমাকে উৎসাহ দিয়ে আসছিল। বলছিল যে, আমি পারবোই।
দ্বিতীয় দিন লাঞ্চের পর মাত্র তৃতীয় টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে দেশের অভিষেক টেস্টেই সেঞ্চুরি করার কীর্তি গড়েন বুলবুল। আগে এই কীর্তি ছিল কেবল অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ব্যানারম্যান ও জিম্বাবুয়ের ডেভিড হটনের।
আমিনুল ইসলাম: আমার সিগনেচার প্যাডেল সুইপ করেই আমি সেঞ্চুরি করি। ওই সিংগেলটা আমার ক্যারিয়ারের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাকে প্রায়ই বলা হয়েছিল, শটটা না খেলতে। কিন্তু সেটা আমার প্রিয় শট ছিল, আর যখন আমি ওই শটটা ভাল খেলতে পারতাম। আমার মনে হত, আমি সারাদিন ব্যাট করে যেতে পারব। ১০৬ নট আউট নিয়ে যখন লাঞ্চে গেলাম, আমাদের বোর্ড সভাপতি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন আমি ব্যানারম্যান এবং হটনের সাথে রেকর্ড গড়েছি। তিনি এও বলেছিলেন, যে আমাকে ব্যানারম্যান এর ১৬৯ এর রেকর্ড আমাকে পার করতে হবে।
আমিনুল ইসলাম প্রায় ৯ ঘন্টা ব্যাট করে ১৪৫ রান করেন, সেই সাথে বাংলাদেশ তাদের ইনিংস শেষ করে ৪০০ রানে, যোশি পাঁচ উইকেট লাভ করে।
সাবা করিম: বাংলাদেশ যে স্কোর দাড় করিয়েছিল, তা একরকম অপ্রত্যাশিতই ছিল। জহির (খান) দ্রুতই ইমপ্যাক্ট ফেলে। কিন্তু আমাদের কুম্বলে ছিল না, কিন্তু যোশি আর কার্ত্তিক ছিল, ওরা দারুণ। ৪০০ করা অনেক বড় প্রচেষ্টা ছিল। তবে আমাদের স্কোয়াডে অনেক ডেপথ ছিল, অনেক অভিজ্ঞতা ছিল। তাই আমরা জানতাম, যদি খেলায় ঠিকমত ফোকাস করি, তাহলে ম্যাচে ফিরে আসতে পারবোই।
নাইমুর রহমান: ৪০০ করার পরই আমরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকায় আমরা জানতাম মাঠ কখন কেমন আচরণ করবে।
সুনীল যোশি: সৌরভ আমাকে বলেছিল যে পুরোম্যাচেই আমাকে অনেক বল করতে হবে। এক প্রান্ত থেকে বোলিং চালিয়ে যেতে হবে। এভাবেই সৌরভের সাথে আমার সম্পর্ক শুরু হয়। এরপর সে আমার ওপর অনেক ভরসা করেছিল। অধিনায়ক এর আত্মবিশ্বাস পেয়ে আমিও খুব আত্মবিশ্বাসী ছিলাম।
উদ্বোধনী জুটিতে শিবসুন্দর দাস ও সদাগোপন রমেশ ১৯ ওভার লড়াই চালান। এরপর বাংলাদেশের অধিনায়ক দুর্জয় প্রথম আঘাত হানেন।
নাইমুর রহমান: একজন অফস্পিনার জানেন তিনি বল কোথায় ফেলতে চান এবং বল থেকে কতটুকু টার্ন চান। সেই হিসেবে আমি সব সময়ই আক্রমণ করতে চেয়েছি, এই ক্ষেত্রে সে (শিবসুন্দর দাস) শুধুমাত্র বল কে ঠিক জায়গায় ফেলেছিল। আমার মনে হয় না,সে খুব বেশি স্পিন আশা করেছিল।
তৃতীয় দিন বাংলাদেশ তাদের চোটা-ক্রান্ত উইকেটরক্ষক খালেদ মাসুদকে বাদেই শুরু করে। শুরুতেই তারা দুই উইকেট তুলে নেয়। আর তার কিছুক্ষণ পরই সবচেয়ে বড় উইকেট, শচীন টেন্ডুলকারকে বলে শর্ট লেগে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন দুর্জয়।
নাইমুর রহমান: টেন্ডুলকার এর উইকেট সব সময়ই অমূল্য। কয়েকটি দ্রুত উইকেটের মাধ্যমে আমরা তাদের ওপর প্রেসার ফেলতে পারি।
ভারত ততক্ষণে ১৯০-৫ তে গিয়ে দাঁড়ায়। তখন পিচে একমাত্র স্বীকৃত ব্যাটসম্যান হিসেনে গাঙ্গুলি ছিলেন ৪৬ রানে অপরাজিত। তার সাথে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে যোগ দেন সাবা করিম। এর কিছুক্ষণ পরই করিম স্টাম্পড হয়ে আউট হন। উইকেটের পেছনে তখন শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ।
সাবা করিম: আমি আমার আউটটাকে পুরোপুরি ভাবে মনে রেখেছি। এটার মূল কারণ ছিল আমার খারাপ দৃষ্টিশক্তি। বলটা অফস্পিনারের সাধারণ একটা ফুলটস ছিল, আমি কাভার ড্রাইভ করতে চেয়েছিলাম, লাইন মিস করি এবং ব্যাটে-বলে করতে পারিনি। বলটা উইকেটরক্ষকের প্যাডে লেগে স্টাম্পে গিয়ে লাগে। আমি আর সৌরভ দলকে ভাল অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছিলাম। এরপরই যোশী আসে উইকেটে।
শাহরিয়ার হোসেন: আমি সাবাকে স্টাম্পিং করেছিলাম, যদিও আমি মূলত ওখানে শুধুমাত্র বল থামানোর জন্যই দাঁড়িয়েছিলাম। আমি এখনও মনে করি, বাংলাদেশের হয়ে প্রথম স্টাম্পিং পাইলটেরই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে, সেটা আমার হয়ে গিয়েছে।
এরপরই গাঙ্গুলি-যোশীর ১২১ রানের জুটি হয়। গাঙ্গুলি ৮৪ করে দুর্জয়ের পঞ্চম শিকার হয়ে আউট হন।
সুনীল যোশি: গাঙ্গুলি যখন আউট হয়, তখন আমাকে বলেছিল, ‘যাই হোক না কেন, তোমাকে শেষ পর্যন্ত থাকতে হবে, পরেরটা আমরা সেখান থেকে দেখব!’
পরবর্তীতে যোশি এবং আগারকার ভারতকে বাংলাদেশের স্কোর পার করায়। কিন্তু যোশি অল্পের জন্য তার প্রথম সেঞ্চুরি থেকে বঞ্চিত হয়। সে ৯২ করে আল শাহরিয়ার এর দুর্দান্ত এক ক্যাচে আউট হন। উইকেটটা যায় মোহাম্মদ রফিকের ঝুলিতে।
সুনীল যোশি: দূর্ভাগ্যবশত, সে দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেয়। পরবর্তীতে আমি যখন বাংলাদেশের হয়ে কোচিং করিয়েছি, তাঁর সাথে দেখা হয়। আমি তখন তাকে বলেছিলাম, তুমি যদি ক্যাচ টা না নিতে, তবে আমার সেঞ্চুরি হত। একই ম্যাচে সেঞ্চুরি আর পাঁচ উইকেট। ভাবো একবার!
সাবা করিম: আমাদের সুনীল এবং আগারকার দু’জনই অনেক ভাল অলরাউন্ডার। এটা তারা বিভিন্ন সময়ে দেখিয়ে এসেছে। ভাগ্যক্রমে সুনীল আর সৌরভ বাকি কাজ করে দিয়েছিল।
সুনীল যোশি: আসলে আমার বিশ্বাস ছিল, অনিলের মত তারকা খেলোয়াড়ের অনুপস্থিতিতে আমি টেস্ট দলে দায়িত্ব নিতে পারবো। আর অধিনায়কের আস্থা ছিল আমার ওপর। যদিও সবাই আমাকে অলরাউন্ডার বলতো কিন্তু আমি জানতাম আমি একজন বোলার, যে কিছুটা ব্যাটও করতে পারি।
দুর্জয় ৬-১৩২ বোলিং ফিগার নিয়ে শেষ করে। সপ্তম বোলার হিসেবে তিনি দেশের টেস্ট অভিষেকে পাঁচ কিংবা তার বেশি সংখ্যক উইকেট পান।
নাইমুর রহমান: নিঃসন্দেহে এটা আমার সেরা পারফরম্যান্স ছিল।আমি দলকে নেতৃত্বও দিচ্ছিলাম,তাই এটা নিঃসন্দেহে আমার ক্রিকেটীয় জীবনে সেরা দিন ছিল।
যদিও ভারতকে স্বাগতিকরা অল আউট করে, কিন্তু তারা ১৪১.৩ ওভার মাঠে ছিল। একটা নতুন দলকে টায়ার্ড বানানোর জন্য যা যথেষ্ট ছিল।
সুনীল যোশি: প্রথম ইনিংসে লিড নেয়ার পর আমরা জানতাম আমরা ম্যাচে চালকের স্থানে আছি। দ্বিতীয় ইনিংস শুরুতেই সচীন সৌরভ আমাদের কি করতে হবে তা সম্পর্কে পরিষ্কার করে দিয়েছিল।
অধিনায়ক হিসেবে প্রথম টেস্টেই নিজের মনোভাব পরিস্কার করে দিয়েছিলেন সৌরভ, বিশেষ করে সেই সময়টায় যখন ভারত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে না। মোমেন্টাম ছিল বাংলাদেশের পক্ষে, আর সৌরভ ছিলেন সুযোগের অপেক্ষায়।
সাবা করিম: প্রথম ম্যাচে অধিনায়ক হিসেবে সৌরভ খুবই শান্ত ছিল। তাঁর ভেতরে কোনো রকম দুঃশ্চিন্তা ছিল না। আমরা ম্যাচটি শেষের দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম না, যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। তাই বেশ কিছু জিনিস চেষ্টা করছিলাম। এর কিছু কাজ করেছিল, কিছু করেনি।
দ্বিতীয় ইনিংসে জবাব দিতে নেমে বাংলাদেশ তাশের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। মাত্র ৯১ রানে অল আউট হয়। শ্রীনাথের বাউন্সারে আহত হন বিদ্যুৎ। দুই অংকের ঘরে পৌঁছান কেবল পাইলট ও সুমন।
শাহরিয়ার হোসেন: আমি মাথায় আঘাত পাই, সম্ভবত রোকনও (আল শাহরিয়ার) ইনজুরিতে ছিল। আমরা নিকটস্থ মেডিকেলে চেক আপ করিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামি।
আমিনুল ইসলাম: এটা আসলে মানসিক চাপ বা ক্লান্তি – কোনোকিছুই ছিল না। এটা ছিল অতি-আত্মবিশ্বাস। আমরা আনন্দে এতটাই উদ্বেল ছিলাম যে, ম্যাচের কঠিন পরিস্থিতিতে কি করতে হবে তার প্রস্তুতি নেইনি। আমরা ভেবেছিলাম প্রথম ইনিংসের মতোই দ্বিতীয় ইনিংসে করতে পারব। কিন্তু একটা টেস্ট ম্যাচের মোড় আধাঘন্টার ব্যবধানে ঘুরে যেতে পারে।
সুনীল যোশি: আমরা ভেবেছিলাম এটা একটা স্পিন সহায়ক উইকেট হবে। কিন্তু, এটা তা ছিল না। এটা একটা স্লো টার্নিং উইকেট ছিল, যার জন্য আমাকে টানা ৪৫ ওভার বল করে যেতে হয়েছিল। এটা মিরপুর হলে ২/৩ দিনেই ম্যাচ শেষ হয়ে যেত।
চতুর্থ দিনের চা বিরতির পরই ভারত নয় উইকেটের বিনিময়ে ম্যাচ জিতে নেয়। স্বাগতিকদের দেখিয়ে দেয়, কিভাবে টেস্ট ম্যাচের রং বদলায়।
সাবা করিম: আমরা বাংলাদেশের বিপক্ষে অনেক ওয়ানডে খেলেছিলাম, তাই জানতাম তারা অনেক ভাল দল। তারা নিজেদের মাঠে খেলছে, তাই তারা যে ভাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তাও জানতাম এবং তারা তা করেও ছিল। প্রথম চার দিন তারা সমানে সমান ছিল, যদিও শেষে এসে আমরা সহজেই জিতে যাই।
আমিনুল ইসলাম: ম্যাচ শেষে দুই দলই একই বাসে ভারতীয় হাইকমিশনারের বাসায় যায়। সেখানে শচীন আমাকে বেশ কিছু টিপস দেয়। আমি ভেবেছিলাম তারা অনেক বড় ক্রিকেটার, হয়তো আমাদেরকে সেভাবে খেয়াল করবে না, কিন্তু আসলে তাঁরা বেশ হেল্পফুল ছিল।
বাংলাদেশের অভিষিক্ত ১১ ক্রিকেটারের মধ্যে বিকাশ রঞ্জন দাস (এখনকার মাহমুদুর রহমান রানা) কেবল একটা টেস্টই খেলেন। আর এটা ছিল উইকেটরক্ষক সাবা করিমের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। তিনি বুঝতে পারেন, চোখের ইনজুরিতে ক্যারিয়ারটা বড় হবে না তাঁর।
সাবা করিম: আমি ম্যাচে প্রায় ২০ টি বাই রান দেই,যা আসলেও দুঃশ্চিতার কারণ ছিল। বিশেষ করে পেস বোলার এর বিপক্ষে কিপিং করা আমার জন্য কষ্টই হচ্ছিল। তাই আমাকে উইকেট কিপিং ছাড়তেই হত।
আমিনুল ইসলাম: সত্যি বলতে প্রথম টেস্টের পরে আমরা সেই পেশাদারিত্বে পৌঁছাতে পারি নি। পরবর্তী ট্যুরের জন্য আমাদের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। ভারতের বিপক্ষে খেলার অভিজ্ঞতা ও কাজে লাগাতে পারিনি। আমরা মূলত আমাদের ওয়ানডে নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিলাম। বিশেষত, ২০০৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপ নিয়ে। কিন্তু তবুও আমরা একটা টেস্ট দলে পরিণত হয়েছিলাম।
মূল লেখা: ‘A Test match can change course in half an hour. That’s what happened to us’। অনুবাদ করেছেন: মোস্তাফিজ রহমান পন্টি।