প্রত্যাশিত, তবুও নতুন খবর ভারতের ক্রিকেট পাড়া থেকে এখন পুরো বিশ্বে ছড়িয়েছে। বিশ্লেষণ, আলোচনা হচ্ছে ভারতের নতুন ওয়ানডে অধিনায়কে নিয়ে। ভারতীয় ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়কের দায়িত্ব পেলেন মারকুটে ব্যাটার রোহিত শর্মা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরপর নিজের দায়িত্ব থেকে সড়ে দাঁড়ান বিরাট কোহলি। তাঁর পরিবর্তে ভারত দলের টি-টোয়েন্টি অধিনায়কের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে ইতোমধ্যে দলকে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতিয়েছেন রোহিত শর্মা।
এখন পেলেন তবে নতুন দায়িত্ব। প্রত্যাশার রয়েছে। সম্ভাবনা রয়েছে দুইরকম ফলাফলের। ব্যর্থতা কিংবা সফলতা। তবে রোহিতের অধিনে খেলা অনেকে খেলোয়াড়দের মত সাফল্যের শিখড় অবধি পৌঁছে যাবেন রোহিত সাথে করে নিয়ে যাবেন পুরো ভারত দলকে। রোহিতের মূল চালিকা শক্তি তাঁর ধূর্ত বুদ্ধি। তাছাড়া খেলোয়াড় ম্যানেজমেন্টটাও তার একটি বড় সক্ষমতা। তবে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে গিয়ে মাঝেমাঝেই সিনিয়র খেলোয়াড়দের চোখ রাঙানিও সহ্য করে নেন তিনি।
একবার তাঁরই সাবেক সতীর্থ যুবরাজ সিং রোহিতকে এ বিষয়ে বলেছিলেন, ‘আমি খেয়াল করি, তুমি সিনিয়রদের সম্মান করো, যা বলে শোনো। মোটা দাগে এটাই তোমার পরিচয়। এটা ভাল, আবার খারাপ। অনেকে যা ইচ্ছা তাই করার সুযোগ পায়। যার যা ইচ্ছা এসে বলে দিয়ে যায়।’
তবুও বেশ ভালভাবেই রোহিত সবার মন রক্ষা করে দলকে ঠিক জয়ের বন্দরে নিয়ে যেতে জানেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের তাঁর অধিনায়কত্ব। তাঁর নেতৃত্বেই ফ্রাঞ্চাইজিটি জিতেছে পাঁচখানা ট্রফি। তবে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স থেকেই অধিনায়ক রোহিত শর্মার উত্থান তা মানতে নারাজ তাঁর সাবেক সতীর্থ ও বাল্যবন্ধু প্রজ্ঞান ওঝা।
ওঝা মনে করেন ডেক্কান চার্জার্স হায়দ্রাবাদ থেকেই রোহিতের অধিনায়ক সত্ত্বার বেড়ে ওঠা।
প্রজ্ঞান বলেন, ‘আমরা সবাই হয়ত জানি যে আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স থেকেই রোহিত শর্মা হয়ে উঠেছেন আজকের রোহিত শর্মা। কিন্তু আমার মনে হয়ে ডেক্কান চার্জার্স থেকেই রোহিতের অধিনায়ক হয়ে ওঠবার যাত্রার শুরু এবং এজন্যে অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে ক্রেডিট দেওয়া উচিৎ। সে রোহিতের মাঝে কিছু একটা দেখেছিল এবং তাঁকে দলের সহ-অধিনায়ক বানান। দলে বেশকিছু সিনিয়র খেলোয়াড় থাকা সত্বেও। রোহিত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কার্যকরী ইনপুট দিতেন।’
এটা রোহিতের অনেক বড় একটি দক্ষতা। যা সময়ের সাথে আরো ধার হয়েছে। আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। মাঠে এখন তিনি নিজের অভিজ্ঞতার উপর ভরসা রেখে বলিষ্ঠ সিধান্ত নিতে শিখেছেন। রোহিতের এই দক্ষতার উপর পূর্ণ আস্থা রেখে তাঁর মুম্বাই সতীর্থ সৌরভ তিওয়ারি বলেন, ‘মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের পাঁচখানা শিরোপার অন্তত দুইখানা জিতেছে রোহিতের অধিনায়কত্বে। ম্যাচের পরিস্থিতি পর্যালোচনায় তিনি খুব তীক্ষ্ণ।’
এসব কিছুর পাশাপাশি একজন দলনেতার সবচেয়ে বড় যে স্কিলটা প্রয়োজন তা হলো, ‘কমিউনিকেশন স্কিল’। রোহিতের এই দক্ষতার প্রমাণ মেলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের পেস বোলার ধাওয়াল কুলকারনির এক বক্তব্য থেকে। কুলকারনি বলেন, ‘একজন খেলোয়াড়ের খারাপ সময় কিংবা ফর্ম থেকে কি করে ভাল সময়ে ফিরিয়ে আনতে হয় তা খুব ভাল করেই জানা রোহিত শর্মা।’
তাছাড়া একজন খেলোয়াড় একজন অধিনায়কের কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করে এমন এক প্রশ্নের জবাব হিসেবে ধাওয়াল বলেন, ‘অধিনায়ক তাঁর সাথে কথা বলবে। দল সম্পর্কে, ওই নির্দিষ্ট খেলোয়াড় সম্পর্কে তাঁর কি অভিমত তা জানাবে। একজন খেলোয়াড় কিভাবে আরো ভাল করতে পারে সেই টোটকা দেবে, এইতো।’ নিজের এই বক্তব্যের সাথে ধাওয়াল আরো জুড়ে দেন, ‘এসব কিছুই রোহিত শর্মা করেন।’
ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের ফর্ম কখনোই সমান থাকে না। হৃদযন্ত্রের কম্পনের গ্রাফের মতো সবসময় ওঠানামা করে। খেলোয়াড়দের ফর্মের গ্রাফ যখন নিম্নগামী তখন একজন অধিনায়ককে সেই খেলোয়াড়কে সাহস জোগাতে হয় তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আশ্বাস দিতে হয়, তাঁর সামর্থ্য সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করতে হয়। রোহিত শর্মা এর সবকিছুই করেন।
এমনকি অধিনায়ক না থাকাকালীন সময়েও খেলোয়াড়দের ব্যাক করেছিলেন। সম্প্রতি আজিঙ্কা রাহানের বাজে ফর্মের কারণবশত তাঁকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়ার এক গুঞ্জনে রোহিত ব্যাক করেছিলেন। তাছাড়া ২০১৮ সালে বক্সিং ডে টেস্টে ভয়ংকর হয়ে ওঠা শন মার্শের উইকেট নিতে তিনিই জসপ্রিত বুমরাহকে দিয়েছিলেন স্লোয়ার ইয়োর্কারের টোটকা।
নিজের সমুন্নত মর্যাদা এবং অসাধারণ ক্রিকেটীয় দক্ষতার কারণবশত তিনি ভারতীয় খেলোয়াড়দের আস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন।
তাঁর সম্পর্কে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের ট্যালেন্ট স্কাউট ও সাবেক ক্রিকেটার পার্থিব প্যাটেল মনে করেন খেলোয়াড়দের সর্বোচ্চ পোটেনশিয়াল নিঙড়ে নিতে জানেন এজন্যে তিনি খেলোয়াড়দের নিজেদেরকে মেলে ধরার পূর্ণ স্বাধীনতাটুকু দেন। পার্দিব আরো বলেন, ‘সে তাদের মন বোঝে, কেননা সে প্রতিটা নির্দিষ্ট খেলোয়াড়দের সাথে সময় কাটান। তাছাড়া বোলারদের স্বকীয় চিন্তা ধারাকে সমর্থন করে ও তা ম্যাচে বাস্তবায়ন করতেও উৎসাহিত করেন।’
মোদ্দা কথা হল, কম্পলিট এক অধিনায়ক প্যাকেজ রোহিত শর্মা। রইলো বাকি তাঁর ধৈর্য্য কিংবা নিজের টেম্পারমেন্ট ধরে রাখা। সেদিক থেকে ভারতের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির সাথে তূলনা করা যায়। সাধরণত অধিনায়কদের প্রবণতা থাকে চিরায়ত নিয়মের বাইরে কোন কিছু চেষ্টা না করা। কিংবা ম্যাচের মোড় ঘুরাতে একজন বোলার কিংবা ব্যাটারের ব্যক্তিগত প্রতিভাই যথেষ্ট বলে মনে করেন। কিন্তু রোহিত এখানটায় ভিন্ন। তিনি ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে সিধান্ত নিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। তাছাড়া নিজের সহজাত প্রবৃত্তির উপর বেশ আস্থা রাখেন রোহিত। এখন শুধু অপেক্ষা ভারতকে সাফল্যের সেই এভারেস্ট চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার।