একটা ডেলিভারি। একটা উইকেট। আর গোটা আহমেদাবাদ—এক লহমায় নিস্তব্ধ। যেখানে লাখো কণ্ঠস্বর ভারতের জয়ের জন্য গলা ফাঁটাচ্ছিল, সেখানে একটা নামে, একটা স্পেলেই স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা ভারত। সেই মানুষটা হলেন প্যাট কামিন্স।
২০২৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে বিরাট কোহলিকে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি শুধু ভারতের মেরুদণ্ডকেই ভেঙে দেননি, তিনি যেন এক দেশের আত্মবিশ্বাসকেই নি:শব্দে থামিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু, এই মুহূর্তটা ছিল বহু বছরের প্রস্তুতির ফল।
ঈশাণ কোণের মেঘে যেমন ঝড়ের আগাম বার্তা থাকে ঝড়ের, প্যাট কামিন্স নামটার মাঝেও ছিল তেমনই এক পূর্বাভাস। অভিষেকেই যখন বল হাতে ঝড় তুললেন, মনে হচ্ছিল—এ বুঝি ব্রেট লি, গ্লেন ম্যাকগ্রাদের যুগ শেষে আসছেন আরেকজন পেস কাণ্ডারি। কিন্তু, ক্রিকেট দেবতা বড়ই নিষ্ঠুর — যাঁকে ভালোবাসেন, তাঁকেই সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেন।
ছেলেটাই একদিন হবে অস্ট্রেলিয়ার পেস আক্রমণের নেতা। অস্ট্রেলিয়ার অন্দরমহলে এই কথাটাই বলতো সবাই। কেউ বলতো, তাঁর শরীর ইস্পাতে গড়া। ২০১১ সালে যখন মাত্র ১৮ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেকে ওয়ান্ডারার্সে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সাত উইকেট নিয়ে জয় এনে দিলেন। অস্ট্রেলিয়া শুধু একজন প্রতিভাকে খুঁজে পেল না, একটা প্রতিজ্ঞাকেও চিনে নিল।
তারপর সেই প্রতিজ্ঞার শরীরেই এল ধাক্কা। বছর বছর চোট, একের পর এক ব্যাক ইনজুরি। পুরো ছয় বছর টেস্টের বাইরে। মনে হচ্ছিল, হয়তো আর ফেরা হবে না। কিন্তু, কামিন্স ফিরলেন। ২০১৭ সালে ভারতে ফিরে এলেন এমন এক বোলার হয়ে, যাঁর শরীর শুধু চোটে ভাঙেনি, ভেতরে তৈরি হয়েছে ভিষণ ভয়ঙ্কর এক ক্ষুধা।
২০১৮ সালের সেই বল টেম্পারিং কেলেঙ্কারির সময় যখন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট চারপাশ থেকে ভেঙে পড়ছিল, তখন কামিন্স হয়ে উঠলেন অজি ক্রিকেটের মুখ। ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে হারে অস্ট্রেলিয়া, তবে কামিন্স যেন একাই লড়েছেন। তার পরের সিরিজেই তিনি পেলেন টেস্টের সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব আসলে ছিল ভবিষ্যতের প্রস্তুতি।
ততদিনে তিনি হয়ে উঠেছেন টেস্টের এক নম্বর বোলার। পেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে মর্যাদার পুরস্কার — অ্যালান বোর্ডার মেডেল। ২০২০-২১ ঘরের মাঠে আবার ভারতের কাছে হেরে যাওয়ার সেই দু:সহ স্মৃতির মধ্যেও কামিন্স ছিলেন আলাদা। লড়ে গেছে, কিন্তু সয়ে যেতে হয়েছে পরাজয়ের যন্ত্রনা।
কিন্তু নেতৃত্বের আসল পরীক্ষা তখনও বাকি ছিল সেটা আসল ২০২১ সালের শেষ দিকে, যখন আচমকা টিম পেইনকে সরিয়ে দিল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)। সময়টা ছিল টালমাটাল। কিন্তু কামিন্স ছিলেন ঠান্ডা মাথার নাবিক। অ্যাশেজে জয়, তারপর পাকিস্তানে ২৪ বছর পর সফর করে সাফল্য—এগুলো শুধুই পরিসংখ্যান নয়, কামিন্সের নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি।
আর ২০২৩ সালটা তো সময়ের খামে বন্দী রাখা একটা উজ্জ্বল অধ্যায়। বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে শুরুটা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। কিন্তু, একজন নেতা কেমন করে দলকে জাগিয়ে তোলে, কেমন করে দু:সময় থেকে টেনে বের করে আনে — সেটা শিখিয়ে দিলেন কামিন্স। ফাইনালে যখন বিরাট কোহলিকে আউট করে দিলেন, গোটা স্টেডিয়ামের গর্জন তখন এক মুহূর্তে থেমে গিয়েছিল। যেন একা হাতে একটা দেশকে থামিয়ে দিলেন প্যাট কামিন্স।
প্রতিপক্ষকে বারবার থামিয়ে নিজেকে ইস্পাত-সম করেছেন কামিন্স। শরীর যতই ভেঙে পড়ুক, হৃদয় যদি জ্বলে ওঠে, তাহলে একদিন না একদিন — জগৎ আপনার নাম মনে রাখবেই। হ্যাঁ, প্যাট কামিন্স নামটা এখন আর ভুলে যাওয়ার জো নেই।