ভাঙা ডানার উড়াল

২০১২ সালে স্প্যানিশ লা লিগায় দেপোর্তিভো লা করুনার বিরুদ্ধে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ৬-০ জেতে এবং সেই ম্যাচে একা ৫ গোল করেন রাদামেল ফ্যালকাও গার্সিয়া নামের একটি স্ট্রাইকার। এখন যেমন ইউরোপীয় ফুটবল ফলো করি, তখন অতটা করতাম না। দেশের ম্যাচগুলোর বাইরে হয়তো ইউসিএলের উপরের দিকের খেলাগুলি বা প্রিমিয়ার লিগ। এইটুকুই ছিল সম্বল। লা লিগা দেখাতো অনেক রাতে। সম্ভব হত না।

আমারই অক্ষমতা। কিন্তু ওই ম্যাচটাই যেন এক ঘুমন্ত বাঘকে জাগিয়ে দিল। বস্তুত দিয়াগো সিমিওনের অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের দর্শন গড়ে উঠেছিল দুই উরুগুয়ান সেন্টার ব্যাক, মাঝমাঠের কোকে, সউল, হুয়ানফ্রান, গাবি, রাউল গার্সিয়া আর ফরোয়ার্ড লাইনের দুই ক্ষুধার্ত শ্বাপদের উপর ভিত্তি করে। দুই শ্বাপদ, ধুর্ত স্প্যানিশ নেকড়ে দিয়েগো কোস্তা এবং কলম্বিয়ান ‘এল টিগ্রে’ ফ্যালকাও।

ফ্যালকাও আসলে মধ্যনাম। তাঁর বাবা, রাদামেল গার্সিয়ার প্রিয়তম ফুটবলারের নাম ছিল ফ্যালকাও। বিরাশির ব্রাজিলের জিকো সক্রেটিসের সঙ্গে মাঝমাঠের স্তম্ভ। তাঁরই নামে নাম রাখা হয়। ছেলেবেলা থেকেই গোলের গন্ধ পেতেন তিনি। বর্ন স্ট্রাইকার। রিভারপ্লেটেই চিনে নিয়েছিলেন দিয়াগো সিমিওনে। এমনকি সিমিওনের কোচিং-এ যখন রিভারপ্লেট পরপর ১১টা ম্যাচ জয়হীন, তখনও নিয়মিত গোল করতেন ফ্যালকাও।

তারপর যখন আন্দ্রে ভিয়া বোয়া-র পোর্তোর হয়ে মাঠে তখনও ইউরোপকে ছিঁড়ে খেলে ফেললেন তিনি। ২০১১ সালে পোর্তো ইউরোপা লিগ চ্যাম্পিয়ন। ফালকাও ১৮টি গোল। ২০১২য় অ্যাটলেতি চ্যাম্পিয়ন ফালকাওয়ের ১২টা গোল।

আসলে ফালকাওয়ের গোলগুলো সাধারণ নয়। ফালকাও যেন ম্যুলার বা বাতিস্তুতার উত্তরসূরী। গোলের গন্ধ পেয়ে যেমন ঠিক জায়গায় ট্যাপ করতে পৌঁছে যেতে পারেন, তেমনই বক্সের বাইরে থেকে ডিফেন্ডারের বাস টার্মিনাসের ভিতর থেকে খুঁজে নিতে পারেন গন্তব্য জালকে। আর হেডের সময় সমস্ত হৃদয় দিয়ে আক্রমণ করেন বলটিকে, ছিলা ছেঁড়া তিরের মতো খুঁজে নেয় পরম আশ্রয় সে।

২০১১ থেকে ২০১৩ কলম্বিয়ার হয়ে বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে লাতিন দলগুলিকে নিয়ে ছিনিমিনি খেললেন। ডিফেন্ডারদের মুহূর্তের অনবধানতায় শেষ পেরেক পুঁতে দিয়ে যান তিনি। চোরা গতি আর শরীরের উর্ধাংশের মনুষ্যোত্তর শক্তি, ডিফেন্ডারদের বাঁধন কেটে গৃহস্থের সর্বনাশ করে দিয়ে চলে যান তিনি। কোয়ালিফায়ারে দ্বিতীয় হয়ে উঠল কলম্বিয়া ব্রাজিলের অবর্তমানে। দ্রুত উঠে আসছেন হামেস রদ্রিগেজ।

সবাই উদগ্রীব রাদেমিল ফালকাওকে ব্রাজিলের মাটিতে বিশ্বকাপে দেখতে। কিন্তু অ্যান্টেরিয়র ক্রুশিয়েটিং লিগামেন্ট বা এসিএল পার্শিয়াল টিয়ার হল তাঁর জানুয়ারিতে, ২০১৪ সালে। অনেক পরিশ্রম করেও ফিট হতে পারলেন না তিনি।

কেন জানি না, অ্যাটলেটিকোও ছেড়ে দিল ফ্যালকাওকে। ফালকাওয়ের ঠাঁই হল মোনাকোতে ফ্রেঞ্চ লিগ ১। সেখানকার পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে লোনে এলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আর তার পরের বছর চেলসিতে। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগে মানিয়ে নিতে পারলেন না। দিয়েগো কস্তা কিন্তু চেলসিতে উচ্চতায় উঠে গেলেন।

ধীরে ধীরে হাঁটুর চোটে গতি কমে গেল, শক্তিও। কিন্তু গোল তো কমে না। ২০১৬-১৭ সিজনে মোনাকোকে লিগ ১ চ্যাম্পিয়ন করালেন ফালকাও। ফালকাও আর বাচ্চা কিলিয়ান এমব্যাপে। তারপর চ্যাম্পিয়নস লিগে সেমি ফাইনালও খেলল মোনাকো। গোল তখনও করছেন ফ্যালকাও। দুই ডিফেন্ডারের মাঝখান দিয়ে চোরাগতি তখনও আছে।

কিন্তু চোটটা বোধহয় সেই তাক লাগানো শিকারি ঈগলের মতো ছিটকে বেরিয়ে নিশ্চিত গোল করে যাওয়াটাকে মেরে ফেলল। পরের বছর কিলিয়ানও চলে গেলেন অন্য আকাশের খোঁজে নেয়মার কাভানির সঙ্গে পিএসজিতে। আর ফালকাওয়ের ঠাঁই হল তুরস্কের গ্যালাতাসারেতে।

সেদিন রাত্রে কলম্বিয়ার হয়ে নেমেছিলেন ব্রাজিলের বিরুদ্ধে। একনম্বর আর নন, সে জায়গাটা জাপাটা নিয়ে নিয়েছেন। পরের জায়গাটা মুরিয়েল। কিন্তু তবু ব্রাজিল বলেই বোধহয় কোচ রুয়েদা ভরসা করেছিলেন ফ্যালকাওয়ের উপর। অতীতের ছায়া তিনি। চোট, হাঁটুর চোট এক ফুটবলারের জন্য অভিশাপ।

আর নাইনকে জিজ্ঞাসা করুন। তবু আজকাল যখন প্রকৃত নাম্বার নাইনের অভাব তখন ওই লোকটাকে মাঠে দেখলে আবার সেই গত দশকের শুরুটা মনে পড়ে যায়। লা লিগা, সিজার ভলিতে গোল করছেন রাদেমিল। রাদেমিল তো তাঁর বাবারও নাম। ফালকাও নামটাকে ভিন্ন দেশে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া একজন অসম্ভব প্রতিভাধরকে সেভাবে দেখা হল না কলম্বিয়ার। দুর্ভাগ্য কলম্বিয়ার, ফুটবলেরও।

কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link