এক ইনিংসে ১০ উইকেটের কীর্তি! টেস্ট ক্রিকেটে জিম লেকার যে কীর্তির শুরুটা করেছিলেন, তার শেষটা করেছেন নিউজিল্যান্ডের এজাজ প্যাটেল। মাঝে ইতিহাসের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে এক ইনিংসে ১০ উইকেটের বিরল কীর্তিতে নাম লিখিয়েছিলেন ভারতের অনিল কুম্বলে।
খানিকটা বিস্ময়ে ডুব দিতেই পারেন, পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটেও কিন্তু এই ১০ উইকেট নেওয়ার কীর্তি রয়েছে। আর সেই কীর্তিতে যে নামটি জড়িয়ে আছে, তিনি ক্রিকেট মানচিত্রে নামে ভারে বড় কোনো দেশের ক্রিকেটার নন। তিনি নেপালের মেহবুব আলম।
২৫ মে, ২০০৮। আইসিসি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ ডিভিশন ৫ এর ম্যাচে সেদিন মুখোমুখি হয়েছিল নেপাল আর মোজাম্বিক। তো প্রথমে ব্যাট করে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে স্কোরবোর্ডে ৭ উইকেটে ২৩৮ রান জমা করে নেপাল। সেই রান তাড়া করতে নেমে মাত্র ১৯ রানেই সবকটি উইকেট হারিয়ে ফেলে মোজাম্বিক। ফলত, ২১৯ রানের জয় পায় নেপাল।
তবে সে দিন ম্যাচ জয়ের চেয়েও রোমাঞ্চ জাগিয়েছিল মোজাম্বিকের স্কোরকার্ড। মোজাম্বিকের ১০ উইকেট একাই নিয়েছিলেন মেহবুব আলম। ৫ টি বোল্ড, ৪ টি এলবিডব্লিউ আর একটি ক্যাচের মাধ্যমে ১০ উইকেট নেওয়া মেহবুবের সেদিন বোলিং ফিগার ছিল ঠিক এমন, ৭.৫-১২-১০!
মেহবুব অবশ্য এমন বোলিং ভেলকি দেখিয়েছিলেন তার আগেও। ২০০৬ সালে মায়ানমারের বিপক্ষে এক ম্যাচে ৩ রান নিয়েছিলেন ৭ টি উইকেট। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে মেহবুব আলমের এমন দুটি বোলিং ফিগারের জায়গা মেলেনি। কারণ, ঐ দুটি ম্যাচের কোনোটিই স্বীকৃত ছিল না। তাছাড়া, একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্ট্যাটাস পেতে নেপালকে অপেক্ষা করতে হয় ২০১৮ সাল পর্যন্ত। এর আগে অবশ্য ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছিল নেপালিরা।
ক্রিকেট ইতিহাসে নেপাল নতুন দল হলেও এশিয়ার এই দেশে ক্রিকেট খেলার চল কিন্ত বহু আগের। হিস্ট্রি অব নেপাল নামক এক বইতে ডেনিয়েল রাইট ১৮৭৭ সালের সময় উল্লেখ করে লেখেন, ‘ঐ সময়ে অনেক তরুণদের রাস্তাঘাটে ক্রিকেট ব্যাট এবং বল নিয়ে দেখা যেত। তবে সেটি খেলা নয়, বিনোদন হিসেবেই ধরা হতো।’
এত আগে ক্রিকেটের প্রচলন থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা বিস্তার লাভ না করার দায় অবশ্য নেপালের বিভিন্ন সময়ের শাসকদেরই। নেপালে ক্রিকেট শুরু হয় রানাদের শাসনামলে। গত শতাব্দীর বিশের দশকে নেপালের মহারাজা চন্দ্র শুমশের জং বাহাদুর রানার ছেলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মদন শুমশের উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড থেকে ফিরে ক্রিকেটের প্রচলন করেন।
কিন্তু তাঁর সেই উদ্যোগ পূর্ণতা পায়নি। ক্রিকেট যেমন শুরুতে অভিজাতদের খেলা ছিল, ঠিক তেমন রানা পরিবারের কাছেও খেলাটি অভিজাতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৪৬ সালে দ্য ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব নেপালের যাত্রা শুরু হলো।
কিন্তু তার পাঁচ বছর পরে এসে বিলুপ্ত ঘটলো রাজতন্ত্রের। এরপর নেপাল ক্রিকেট শুধু পিছিয়েই যেতে থাকে। ১৯৬১ সালে নেপাল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনকে নেওয়া হয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধীনে।
১৯৮৮ সালে আইসিসির সদস্যপদ পায় নেপাল। তবে বিশ্ব ক্রিকেটে নেপালের আগমন ঘটে তারও বেশ কিছু বছর পরে, ২০০২ সালে। সেবার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে তাঁরা। শুধু অংশগ্রহণই নয়, সেবার সালমান বাটের পাকিস্তানকে হারায় তাঁরা। একই সাথে, সেবারে যুব বিশ্বকাপে নেপালের কাছে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল বাংলাদেশকেও।
৪ বছর বাদে ২০০৬ যুব বিশ্বকাপে প্লেট পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয় নেপাল। আর সেই শিরোপা জয়ের পথে তাঁরা হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ড অনূর্ধ্ব ১৯ দলকে। নেপালের সেরা সাফল্য আসে ঐ দশকেই। ২০১০ সালে ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ ডিভিশন ৫ এর শিরোপা জিতে নেপাল। একই বছরে, মেয়েদের ক্রিকেটেও তাঁরা একই শিরোপা জেতে।
আর এরপরেই তাঁরা ক্রিকেটে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার এশিয়া কাপের মঞ্চে প্রথমবারের মতো পা রাখার যোগ্যতা অর্জন করেছে নেপাল। তবে নেপাল ক্রিকেটের গল্পে নেই সাফল্যের ধারাবাহিকতা।
আজ সাফল্যের চূড়ায় তো, কাল ব্যর্থতার তলানিতে- এটাই যেন তাদের ক্রিকেটে মিশে গিয়েছে। এই যেমন ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার কোয়ালিফায়ারে জায়গা পেতে শেষ ১২ ম্যাচে অন্তত ১১ জয় পেতে হতো নেপালকে। নেপালিরা সেটিই করে দেখিয়েছিল। কিন্তু জুনে জিম্বাবুয়েতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সুপার সিক্সেই উঠতে পারেনি নেপালিরা।
তবে ক্রিকেট নিয়ে নেপালিদের স্বপ্নটা বরাবরই এভারেস্টসম চূড়ার মতোই। বাইশ গজ নিয়ে সে স্বপ্নের সর্বোচ্চ শৃঙ্গজয়ও নিশ্চয় একদিন হবে। নেপালিদের রন্ধ্রে যে রয়েছে শেরপাদের মতো হাল না ছাড়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টা আর অদম্য মানসিকতা।