মাঠের ভিতরে কিংবা বাইরে – দুই জায়গায়ই আলোচিত এক নাম। দুর্দান্ত সব ট্যাকটিকস দিয়ে প্রতিপক্ষকে কাবু করা আর ডাগআউটে তার আক্রমণাত্মক ভঙ্গি – আলোচনার জন্ম দিয়েছে বহুবার। খেলাশেষে তার প্রেস ব্রিফিং- রীতিমতো খবরের শিরোনাম। পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে ইতিহাস গড়েছেন মাঠের পাশে থেকে।
স্বঘোষিত স্পেশাল ওয়ান একজন পর্তুগিজ ফুটবল কোচ। নামটি অতি পরিচিত বটে – হোসে মারিও দস সান্তোস মরিনহো ফেলিক্স, সাধারণভাবে হোসে মরিনহো নামে পরিচিত। ফুটবল মাঠে তাঁর মত অদ্ভুত, প্রতাপশালী, লড়াকু কিংবা বদমেজাজী চরিত্র আর আসেনি বললেই হলে। কিন্তু এ কি! এবার সেই প্রতাপশালী মানুষটার চোখ অশ্রুসজল।
এই ট্যাকটিশিয়ান এর আগে দুইবার খেলেছিলেন উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে, দুবার খেলেছেন ইউরোপা লিগের ফাইনালে। না, কোনবারই শিরোপা না জিতে ফেরেননি স্পেশাল ওয়ান। আর এবার, ইতালিয়ান ক্লাব এএস রোমার হয়ে ইউরোপা কনফারেন্স লিগ জিতলেন তিনি। আর এর মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির দীর্ঘ এক ইউরোপিয়ান শিরোপা খরা কেটেছে। এছাড়া এমন জয়ের ফলে ইউরোপের সব শিরোপা জয়ের দারুণ এক কীর্তি গড়েছেন মরিনহো।
নিজ দেশের ক্লাব স্পোর্টিং লিসবনের অনুবাদক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল জোসে মরিনহোর। অবশ্য শুধু ভাষায় পারদর্শিতার কারণেই মরিনহোকে নিয়োগ দেয়া হয়নি বরং বেশ কিছু ক্লাবে স্কাউটের দায়িত্ব পালন করা মরিনহোর ফুটবলজ্ঞানও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল। লিসবনের কোচ ববি রবসনের সাথে এইসময় বেশ ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠে তার।
রবসন-মরিনহো জুটি এতটাই জমে উঠেছিল যে পরবর্তীতে রবসন যখন বার্সেলোনার কোচ হয়ে আসেন তখন নিজে সুপারিশ করে মরিনহোকে ম্যানেজম্যান্টের সদস্য করে ছিলেন। শুরুর দিকে সবাই মরিনহো’কে অনুবাদক ভাবলেও কিছুদিন পরেই পরিষ্কার হয়ে উঠে যে মরিনহো মূলত রবসনের সহকারী কোচের ভুমিকা পালন করে থাকেন।
এরপর নানা নাটকীয়তায় বার্সার সহকারী কোচের চাকরি ছেড়ে যোগ দেন বেনফিকাতে। তবে জোসে মরিনহো প্রথম লাইমলাইটে আসেন এফসি পোর্তোর হয়ে। গড়পড়তা একটি পর্তুগিজ ক্লাবকে ইউরোপ সেরার মুকুট এনে দেন এই মাস্টারমাইন্ড। পুরো ইউরোপ তখন জানতে পারে এফসি পোর্তোর নাম, জানতে পারে একজন স্পেশাল ওয়ানের নাম।
এরই ধারাবাহিকতায় বড় দলগুলো আগ্রহী হয়ে উঠে মরিনহোকে পেতে। ইংলিশ ক্লাব চেলসি’র হয়ে এরপর কোচিং ক্যারিয়ার শুরু হয় তার। সেসময় দ্য ব্লুজদের প্রথাগত ৪-৪-২ ছক ভেঙে ৪-৩-৩ ছকে নতুন করে সাজিয়ে তুলেন দলটি। এর আগের পঞ্চাশ বছরে কখনো লিগ না জেতা দলটি মরিনহোর অধীনে পরপর দুইবার লিগ শিরোপা ঘরে তুলে।
পুরোনো ক্লাব বার্সেলোনা ২০০৮ সালে হঠাৎ আগ্রহী হয়ে উঠে মরিনহোকে নিয়োগ দেয়ার জন্য। কিন্তু মরিনহো’র ফুটবল দর্শন ইয়োহান ক্রুইফের পছন্দ না হওয়ায় শেষমুহূর্তে বদলে যায় দৃশ্যপট। মরিনহোকে বাদ দিয়ে বার্সেলোনার বি দলের কোচ পেপ গার্দিওলাকে মূল দলের দায়িত্ব দেয়া হয়।
সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার পরও শেষ মুহূর্তের এমন পটবদল মরিনহোর মনে বেশ প্রভাব রেখেছিল। আর এজন্য হয়তো শুরুর সাথী বার্সেলোনার সঙ্গে এরপর থেকে শত্রুতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। বার্সেলোনার হয়ে কাজ করতে না পারলেও মরিনহো পেয়ে যান ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানের দায়িত্ব।
আর এই মাঝারি মানের দলটির হয়ে অবিশ্বাস্য বিপ্লব ঘটান তিনি। জিতে নেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, সিরি-আঁ সহ সম্ভাব্য সব মেজর ট্রফি। ২০০৯-১০ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে বার্সাকে টপকে ইন্টার মিলানকে ফাইনালে নেয়ার পর মরিনহোর উচ্ছ্বাস, তার ইন্টার মিলান অধ্যায়ের সবচেয়ে স্মরণীয় অধ্যায়।
সে বছরই রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হিসেবে চুক্তি স্বাক্ষর করেন হোসে মরিনহো। সেই সময়টাতে লা লিগায় ছিল বার্সেলোনা অপ্রতিরোধ্য। আর এই অজেয় কাতালান দুর্গ গুড়িয়ে দিয়েই স্পেনে রিয়াল মাদ্রিদের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন এই পর্তুগিজ কোচ। লা লিগাতে রেকর্ড ১০০ পয়েন্ট অর্জন করে শিরোপা জিতেছিলেন তিনি।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে উঠেছিলেন পরপর দুইবার। ইউরোপের মঞ্চে বড় কোন সাফল্য না থাকলেও লস ব্ল্যাঙ্কোসদের পরবর্তী সময়ের সাফল্য ভিত্তি মরিনহোই তৈরি করেছিলেন। আর তাইতো আজও সারাবিশ্বের মাদ্রিদিস্তারা শ্রদ্ধাভরেই স্মরন করে স্পেশাল ওয়ানকে।
রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়ার পরে মরিনহো আবারও ফিরেছিলেন ইংল্যান্ডে। প্রথমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আর পরবর্তীতে টটেনহ্যাম হটস্পারের ম্যানেজারের আসনে বসেছিলেন তিনি। স্যার অ্যালেক্স ফারগুসনের পরবর্তী সময়টাতে নিশ্চিতভাবেই রেড ডেভিলদের সেরা কোচ হোসে মরিনহো।
ক্লাবটির সর্বশেষ ট্রফিও এসেছিল তার আমলে। এছাড়া কখনোই বড় কোন শিরোপা না জেতা টটেনহ্যামকে মরিনহো নিয়ে গিয়েছিলেন লিগ কাপের ফাইনালে। যদিও ক্লাব ম্যানেজম্যান্ট তাকে ফাইনালের আগেই বাদ দেয়ায় দায়িত্ব চালিয়ে যেতে পারেননি, টটেনহ্যামও জিততে পারেনি সেই ফাইনাল।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও টটেনহ্যাম হটস্পারের সঙ্গে সময়টা ভালো যায় নি মরিনহোর। প্রত্যাশিত ফল না পাওয়া এবং ড্রেসিংরুম বিতর্কের ফলে অনেকেই মরিনহোর ক্যারিয়ার শেষ ধরে নিয়েছিলেন। সবশেষ জোসে মরিনহো যোগ দিয়েছিলেন রোমাতে। আর দায়িত্ব নিয়েই নিজের পুরোনো রূপে ফিরেছেন স্পেশাল ওয়ান৷ তাঁর কোচিংয়েই ১৯৯১ সালের পর প্রথম ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে উঠেছিল রোমা।
মরিনহো তো ফাইনাল খেলেন না, তিনি ফাইনাল জিতেন – এমন কথাকে পঞ্চমবারের মত সত্য প্রমাণ করে ফেনুইয়ার্দকে হারিয়ে ফাইনালে শেষ হাসি হেসেছেন এই টেকটিশিয়ান। হ্যাঁ, সেই হাসি, সেই আনন্দ আর সেই উচ্ছ্বাসটাই কান্না হয়ে ঝরেছে।
শত সহস্র সমালোচনা, বিনয়ের অভাব এবং প্রতিনিয়ত অতিনাটকীয় ঘটনার জন্ম দেওয়া সত্ত্বেও কোচ মরিনহোকে ভালবাসা যায়। ফুটবলের প্রতি তার আবেগ তাকে এমন ভালবাসা এনে দিয়েছে। আর তাই হয়তো উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা স্বত্বেও কনফারেন্স লিগের ফাইনালে উঠে কেঁদে ফেলেছেন মরিনহো; কারণ তিনি বুঝেছেন ট্রফিটার গুরুত্ব, হৃদয়ে ধারণ করতে পেরেছেন এএস রোমাকে।
চাতুর্যের সাথে অসাধারণ ফুটবল জ্ঞান মিলে এমন এক পাগলাটে কোচকে ফুটবল বিশ্ব পেয়েছে যা আর কখনো আসবে কিনা সন্দেহ। মরিনহোর সরব উপস্থিতি ছিল ফুটবলে। তাঁর দর্শনকে বীরের বেশে একটা সময় বরণ করে নিয়েছিল প্রায় সবাই। তবে নতুনত্বের অভাবে বর্তমানে কিছুটা পিছনের সারিতেই আছেন এক সময়ের মাঠ ও মিডিয়া কাঁপানো মরিনহো আর তাঁর ফুটবল দর্শন। হয়তো এটাই শেষ নয়, আবারো নতুন করে ফিরে আসবেন একরোখা একজন স্পেশাল ওয়ান।