বিলেতের হাই রেট ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে লক্ষ্মীর ভাড় সমৃদ্ধ করতে আইসিসি সদর দপ্তর লন্ডন থেকে দুবাই থেকে চলে আসে ২০০৫ সালে৷ আজ, ১৬ বছর বাদে, সেই কসমোপলিটান লন্ডন শহর এবার যেন নিজেই ফিরে আসলো মরুভূমির দুবাইতে!
২০১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালের পর ঠিক ৮৫০ দিন পার হয়ে গিয়েছে৷ এই সময়ে করোনা ঝড়ে ক্রিকেট সহ পৃথিবীর বহু কিছুই উল্টে পাল্টে গিয়েছে৷ তাই, মুখে হয়তো বলা হবে, ওই ঝড় ওঠা রাত কেবলই অতীত৷ এটা আর পাঁচটা ম্যাচের মতই নতুন একটা ম্যাচ৷ কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা৷ আগামীকাল যে বাইশ ক্রিকেটার মাঠে নামবেন, তাদের মাঝে চার-পাঁচ জন বাদে সবাই সেই মোহনীয়, থ্রিলার সিনেমার চেয়েও শ্বাসরুদ্ধকর লর্ডসে উপস্থিত ছিলেন৷
জানি তাঁরা পেশাদার ক্রিকেটার কিন্তু তারাও তো মানুষ, রোবট নিশ্চয় নন ৷ ১৪ জুলাইয়ের সেই রাতে, সেই ফাইনাল তো পুরো বিশ্ববাসীকে হতচকিত করে ফেলেছিল। অনেকেই বলেন, মঙ্গল গ্রহ থেকে এলিয়েনরা পর্যন্ত সেটা চেটে পুটে উপভোগ করেছে৷ কাজেই আগামীকাল রাতে দুই দলের প্লেয়াররা মুখে যাই বলুন, অন্তরের প্রতিটি অনুভুতিতে সেটা কম্পন ধরাবেই৷
নিত্য জীবনে আমরা কত কিছুই না আশা করি৷ কিন্তু কেন উইলিয়ামসন নামের মানুষটির মনে আশা নামক শব্দটি ভিন্ন খেলা করে৷ সেই ফাইনালে যখন ইংলিশদের ৩ বলে ৯ রান দরকার বিশ্বকাপকে প্রথমবার তার আতুড়ঘরে নেবার, তখন তাবত বিশ্ববাসীর অন্তত ৮০% মানুষের ধারণা কিংবা আশা, যাই বলুন, কাপ এবার তাসমান সাগর পাড়ি দিয়ে নিউজিল্যান্ডই যাবে৷
কে জানতো, ঠিক পরের বলে এক থ্রো এর মাধ্যমে লর্ডসের নায়ক বেন স্টোকসের ব্যাটে লেগে বলটা আচমকা বলটা বাউন্ডারি পার হয়ে ২ বলে ৩ রান এর সহজ সমীকরণ এনে দেবে! না আপনি জানতেন, না আমি জানতাম ৷ কিন্তু এমন চরম নাটকীয় মোড় কেন উইলিয়ামসন কে হতচকিত করেনি৷ তাঁর সাধকসুলভ চেহারায় ছিল না কোন রাগ, না ছিল হতাশা৷ মিড উইকেট থেকে ঐ থ্রো তে স্টোকস রান আউট হতে পারতেন৷
৬ এর বদলে কোন রান নাও আসতে পারতো৷ তারপর বল যখন বাউন্ডারি ছুয়ে যায় তখন স্টোকসরা দ্বিতীয় রান পূর্ণ করতে পারেন নি৷ কিন্তু বিধি বাম! নিয়ম অনুসারে যেটা ৫ রান হবার কথা, আম্পায়াররা সেটা সিগন্যাল দিলেন ৬ রানের, বোধকরি দর্শক আর প্লেয়ারদের মতন তারাও হতবিহ্বল ছিলেন।
বিশ্বাস করুন, এতো বড় দুর্ভাগ্য আর অবিচারের শিকার হয়ে বিশ্বকাপ হাতছাড়া হলে যে কোন উপমহাদেশীয় অধিনায়ক রাগে ক্ষোভে আইসিসিকে ধুয়ে ফেলতেন, তার দেশের মিডিয়া এটা নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে দিত ৷ কিন্তু কিউই ক্যাপ্টেন ছিলেন স্থির, সৌম্য আর ভবলেশহীন। ঐ হারের আধাঘণ্টার মধ্যেই সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছিলেন, সেখান থেকে তিনটে লাইন হুবহু তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারছি না – ‘সবাই যা হতে চায়, সে সেটাই হতে পারে আর এটাই আমার কাছে বিশ্ব সংসারের সৌন্দর্য্য। সবারই নিজের সামর্থ অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব সেরা হওয়ার চেষ্টা করা উচিত ৷ শুধু নিজে যা করেছেন, তা উপভোগ করুন।’
ভাবুন, একটা মানুষ সম্পূর্ণ দুর্ভাগ্য আর অন্যের ভুলের কারণে ক্রিকেট মঞ্চের সেরা জিনিসটা হাত থেকে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছেন আর তার পরপরই এমন কথা। সত্যি করেই বলছি, কাল একটা সঠিক বিচার হোক। প্রকৃতি শুন্যতা পছন্দ করে না ৷ দুর্ভাগ্যের শিকলে পিষ্ট হওয়া ঐ ক্রিকেট সাধকের মুখখানা কাল হেসে উঠুক প্রকৃতির বিচারে ৷ অবশ্যই মানছি, ইংল্যান্ড অতি সুন্দর ক্রিকেট খেলছে। জেসন রয় নেই বলে, তার বদলে যিনি থাকবে (সম্ভবত স্যাম বিলিংস) তিনি কিন্তু কানা বা খোঁড়া নন। সব দিক থেকে পূর্ণতায় ভরা এক দল এখন ইংল্যান্ড।
আমার ক্রিকেট মস্তিষ্ক ক্ষুদ্র হলেও সেটা বলছে, কাল ইংল্যান্ডের জয় না পাওয়ার উপযুক্ত কারণ নেই। কিন্তু হৃদয় বলছে, অবশ্যই একটা উপযুক্ত কারণ আছে ৷ নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনে কিছুটা গড়বড় থাকলেও হৃদয় দিয়ে অনুভব করছি, তারা জিতুক এই ম্যাচ। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তো সব ব্যাটসম্যান কে খেলতে হয় না। মন থেকেই চাইছি, এক দুই জন কিউই ব্যাটসম্যান এমন ঝড় তুলুক যে দীর্ঘ ৮৫০ দিনের একটা জ্বালা একটু উপশম হোক।
আমার ব্রেইন থেকে আমার হৃদয়ের কাজ কিন্তু বেশি ঘটে। হোক না, আরেকটা জাজমেন্ট ডে!