সিডনির আকাশে-বাতাসে তখন কেবল ঈশ! উফ! শব্দ। সেই শব্দের আবহে উত্তেজনার পারদ ছুঁয়েছে পর্বতচূড়া। পিচের চারপাশে আমব্রেলা ফিল্ড সাজিয়েছেন প্যাট কামিন্স।
স্ট্রাইকে ছিলেন সব ঝড়ঝাপটা সামাল দেয়ার চেষ্টা করা জনি বেয়ারস্টো। ইনিংসজুড়েই একের পর যেন আগুনের গোলা ছুটে গেছে তার দিকে। সাঁই করে বাতাস কেটে বেরিয়ে গেছে স্টার্ক, বোল্যান্ড, কামিন্সদের হাত থেকে। রেড চেরিতেও আগুন জ্বালানো যায় বটে।
বলছিলাম আমব্রেলা ফিল্ড পজিশনের কথা। চারটা স্লিপ, একটা গালি, লেগ স্লিপ, ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ, সিলি পয়েন্ট। ওদিকে স্কয়ার লেগ সার্কেলের মাঝে। বেয়ারস্টোর জন্য কামিন্সের ফিল্ড প্লেসমেন্ট।
হয় বাউন্সার যাবে, নয় ব্যাক অফ আ লেন্থ থেকে রাইজিং ডেলিভারি, নয় রিব কেজের আশেপাশে। ব্যাটসম্যান বাবাজি পালাবে কোথায়? মারতে যাওয়ার রিস্ক নেবে না। ঠেকাতে গেলেও ক্লোজ ইন ফিল্ডাররা ওৎ পেতে আছে। ছাড়তে গিয়েও কটা ছাড়বে? ইন্টেন্ট তো বলবে মেরে দিই। মন বলে না, কিন্তু জিহবা বলে খা।
গোটা সিরিজে ইংল্যান্ডকে যেভাবে উড়িয়ে দিয়েছে অজিরা। হাতেকলমে তারই একটা সচিত্র উদাহরণ দেখিয়েছেন কামিন্স। প্রতীকী চিত্র।
বেয়ারস্টো তো ফিরেছেন। সেই ফিল্ডিং কর্ডনেই ধরা পড়ে।
লিচ আগলে ছিলেন আরেক প্রান্ত। এমন সিচুয়েশনে আগেও পড়েছেন তিনি। ২০১৯ এর হেডিংলি টেস্ট। স্টোকসের হিরোইক ইনিংস, লায়নের রান আউট মিস, হ্যাজলউড-পেইনের রিভিউ ব্লান্ডার। মনে পড়ে? সেই ইনিংসে মাত্র এক রান করেছিলেন। সবচেয়ে দামী আর ইফেক্টিভ একটা রান। সেই লিচ আজও ছিলেন৷ শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি অবশ্য।
বেয়ারস্টো যখন আউট হন, তখনো দিনের প্রায় দশ ওভার বাকি। ব্রড আর লিচ মিলে ঠেকিয়ে দিলেন সাত ওভার। লায়ন, গ্রিন; সবাইকে দিয়েই ট্রাই করছেন কামিন্স। উহু! উইকেট তো আসছে না।
ওদিকে ব্যাড লাইট আসন্ন। থার্ড আম্পায়ার জানিয়ে দিলেন, সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। স্মিথের হাতে উঠলো বল। শেষ টেস্ট উইকেটটা পেয়েছিলেন ছয় বছর আগে। উইকেট খরার এই স্ট্রিকটা তখনই ভেঙেছেন স্মিথ। ভেঙেছে ব্রড-লিচের ডেডলকটাও। ওভারের শেষ বলে। দারুণ একটা ডেলিভারিতে, স্লিপে দুর্দান্ত ক্যাচটা নিয়েছেন ওয়ার্নার।
পরের ওভারে নাথান লিঁওকে একাই ঠেকালেন ব্রড। অন্য এন্ডে তখন মিস্টার নট আউট জিমি অ্যান্ডারসন। গুনে গুনে ছয়টা বলই ডট, আর ব্লক।
যুদ্ধটা তখন জিমি আর স্মিথের। দুজনের সামনে একটাই ইকুয়েশন; এক ওভার-এক উইকেট। একজনের লক্ষ্য এক ওভার পার করা, আরেকজনের চাই একটা উইকেট।
টাইট ফিল্ডিং নিয়ে, ঝুলিয়ে দেয়া টসড আপ ডেলিভারিতে জিমিকে সামনের পায়ে খেলিয়েছেন, হার্ড লেন্থটায় পিচ করিয়ে টার্নে ধোকা দিতে চেয়েছেন। রাফে ফেলতে চেয়েছেন। যদি একটু ভুল করেন জিমি। কাজ হয়নি। জিমি ভুল করেননি। লং হপড লাস্ট ডেলিভারিটাও আলতো হাতে কন্ট্রোল করেছেন।
জুটি বেঁধে কত উইকেটই তো নিয়েছেন জিমি-ব্রড। এবার জুটি বেঁধে দলকে উদ্ধার করলেন খাদের একদম কিনারা থেকে। ম্যাচের ফলাফল ড্র, এটাই চেয়েছিল ইংল্যান্ড। তবে জয়ের চেয়েও কম নয়।
জয়-পরাজয়ের মাঝের সূক্ষ্ম লাইনটা ছিল এই ড্র। সাবধানে, সযত্নে এই লাইনটা এঁকে দিয়েছেন দুজন। জিমি বোধহয় একটু বেশি।
টেস্ট ক্রিকেটের শেষদিনের শেষ সেশনের শেষ ঘণ্টা। এরচেয়ে দারুণ কিছু হয়ই না। পিচ ফাঁটে, ক্র্যাক ধরে, রাফ বাড়ে। বাড়ে রোমাঞ্চ, বাড়ে ক্রিকেটের মজা। পতপত করে উড়তে থাকে রয়েল এই ফরম্যাটের মজা।
মার্নাস লাবুশেন যেমনটা ছন্দ মিলিয়ে টুইট করেছেন, ‘Day 5, last hour, all around the bat. Not many things better than that. What a sport this is’, হ্যাশট্যাগে #Ashes.
এমন ছন্দই তো টেস্ট ক্রিকেটের আনন্দ। পরমানন্দ। হয়, এমন টেস্ট ক্রিকেটেই হয়। এখানে ক্রিকেট ছাড়া অন্য কিছুও হয়।