দিন বদলের গান গাইছে বাংলাদেশ। আর সেই দিন বদলের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটেও। সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ পেয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতির দায়িত্ব। এখানেই শেষ নয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রনালয় থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সাথেও। সাবেক এই অধিনায়ক এই তথ্য নিশ্চিত করে খেলা ৭১ এর সাথে মুখোমুখি হয়েছিলেন এক লম্বা কথোপকথনে।
- (আমিনুল ইসলাম) বুলবুল ভাই, বিসিবিতে তো এখন পরিবর্তনের হাওয়া। বোর্ডে আপনি কোনো একটা ভূমিকায় আসতে পারেন, এমনও শোনা যাচ্ছে…
– সপ্তাহ দুয়েক আগে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার (আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া) পক্ষ থেকে একজন আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। শুধু আমি না আরও কয়েক জনের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। একজন সাংবাদিকও ছিলেন। আমাদের কাছে ক্রিকেটের জন্য, বোর্ডের জন্য তাঁরা একটা রূপরেখা চেয়েছিলেন। এখন তিনি আমাকে বোর্ডে বা ক্রিকেটে চান কি না, সেটা নিয়ে সরাসরি কোনো কথা হয়নি।
- বোর্ডে কোনো ভূমিকায় কাজ করার সুযোগ বা প্রস্তাব থাকলে কি আমরা আপনাকে পাবো?
– আমি তো আইসিসির চাকরি করি। তাই, হুট করে আসলে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। তবে, হ্যাঁ, আমি দেশের ক্রিকেটের জন্য কাজ করতে চাই। তার জন্য আগে অবস্থার পরিবর্তন দেখতে চাই। গত ১২ বছর আসলে আমাদের বোর্ড লক্ষ্যহীন ভাবে চলেছে। এখন সবাই পরিবর্তনের কথা বলছে। বোর্ডে ফারুক ভাই এসেছেন, ফাহিম ভাই এসেছেন। তবে, আমার কাছে বোর্ডের লক্ষ্যটা এখনও পরিস্কার নয়। আমাকে কাজ করার সুযোগ দিতে হলে বোর্ডের পরিবেশটা পাল্টাতে হবে। গত ১২ বছর যে পরিবেশ আমি দেখেছি, সেই ভাবে কাজ করা সম্ভব নয়।
- বোর্ডে ফারুক ভাই আসলেও কিছু বিতর্কিত চরিত্র এখনও আছেন, তাঁদের নিয়ে অনেক সমালোচনাও আছে আগে-পরে। তারা থাকলে কি পরিবর্তন সম্ভব?
– এটা নির্ভর করবে বোর্ড সভাপতির ওপর। আমি ফারুক ভাইয়ের প্রেস কনফারেন্সে অনেককেই দেখলাম। গ্রাউন্ডস অ্যান্ড ফ্যাসিলিটিজ নিয়ে অনেক কথা হয়। তাঁদেরকেও দেখলাম। এখানে আমি অনেক রকম সিন্ডিকেটের কথা শুনি। এখন, এটা ভাঙবে না থাকলে – সেটা নির্ভর করবে আসলে বোর্ডের পলিসির ওপর। সেজন্য তাই বোর্ডের লক্ষ্য থাকা জরুরী। আপনি আমাকে বলেন, গত ১২ বছর আসলে আমরা কি লক্ষ্যে কাজ করেছি? আমাদের কোনো লক্ষ্য ঠিক না, এখন একটা গোল সেট করা থাকলে আপনি বুঝবেন কোথায় কোন লোকটাকে দরকার।
আর এসব বিতর্ক আর সিন্ডিকেট নিয়ে গণমাধ্যমেরও কথা বলা উচিৎ। একটা দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে এতগুলো ছেলে প্রাণ দিল। এখন যদি এসব সামনে না আসে, তাহলে আর কবে?
- বিসিবিতে বিদেশি কোচ আনার ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেটের কথা শোনা যায়। ফারুক ভাই নিজেও কোচ হিসেবে চান্দিকা হাতুরুসিংহে রাখতে চান না…
– এখানে হাতুরুসিংহে কিন্তু সাবজেক্ট না। হাতুরুসিংহে-কে সরিয়ে দেওয়াই কিন্তু সমাধান না। আপনার ভাল কোচ লাগবে। ভাল কোচ কিভাবে আনা যায় সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে। কোনো সিন্ডিকেট থাকলে সেটা ভাঙতে হবে।
আমাদের কোচদের সাথে চুক্তিতেও সমস্যা আছে। আমি দেখেছি, রাসেল ডোমিঙ্গোকে যখন আমরা ছেড়ে দিলাম, তখন ওকে পুরো চুক্তির টাকা দিতে হল। চাইলেই চুক্তিটা এমন হতে পারত যে ওকে শুধু তিন মাসের বেতন দিয়ে আমরা ছেড়ে দিতে পারব। মোট কথা, যিনি কোচদের মধ্যে মধ্যস্থতা করছেন – সেটাতে তাঁকে আরও দক্ষ হতে হবে।
- ঘরোয়া ক্রিকেটে কোচিংয়ের প্রসঙ্গ আসলে এখনও অনেকে আপনার নাম নিয়ে থাকেন…
আমি তো এখন আর কোচিং করাই না। আমি কোচদের কোচিং করাই। আমার কাজ কোচদের নিয়ে। আমি ট্রেনিং দেই। আমাকে দিয়ে কোচিং করানোর চিন্তা বাদ দিতে হবে। আমি মনে করি, ঘরোয়া ক্রিকেটে ভাল মানের কোচের সংখ্যাটা বাড়াতে হবে।
আর কোচ বানাতে হবে। আমাদের কোচদের নিয়ে কি কাজ হয়? আমাদের কয়জন কোচের লেভেল থ্রি লাইসেন্স আছে? বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশে একটা লেভেল ২ কোচিং ওয়ার্কশপ হয়, তাও জোড়াতালির। এটা দিয়ে আপনি কোন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখবেন। ক্রিকেটারদের যেমন কোচিং দরকার, কোচদেরও দরকার। সেই স্কোপটা আমরা দিতে পারছি কোথায়?
- এখন যে অবস্থার কথা বলছেন, তাতে কি আমাদের আন্তর্জাতিক মানের কোনো কোচ আছেন? যাকে জাতীয় দলের দায়িত্ব দেওয়া যায়?
– আপনি সুযোগ দিয়ে দেখেন না। এখন যা হচ্ছে, তাঁর চেয়ে খারাপ কিছু তো আর হবে না নিশ্চয়ই। দেশের কোচ বললেই এখন সবাই মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের কথা বলে। এর বাইরে ইমরান ভাই, বাবুল, সোহেলরা আছেন। এই সংখ্যাটা যথেষ্ট নয়। এই সংখ্যাটা তখনই বাড়বে যখন আপনার বোর্ডে নিয়মিত ওয়ার্কশপ হবে। আর যারা আছেন কোয়ালিটিতে তারাও এগিয়ে যাবেন।
- বুলবুল ভাই আমরা এতদিন আসলে খেলোয়াড়দের কাউকে বোর্ডের শীর্ষ স্থানে দেখিনি। ভারতে বা পাকিস্তানে দেখেছি। বাংলাদেশে আগে কখনও হয়নি। এটা আসলে কতটা ইতিবাচক হতে পারে আমাদের জন্য?
হ্যাঁ, আমি একটা কথা তো বারবারই বলছি, গত ১২ বছর আমরা অন্ধকারে ছিলাম। আমরা লক্ষ্যহীন ভাবে কাজ করেছি। যে মানুষটা দায়িত্বে ছিলেন, তিনি কি করেছেন দেশের ক্রিকেটের জন্য? আমার তাঁর সাথে কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় নেই, তাঁর সাথে আমি আমি একটা দিনও কোথাও কাজ করিনি। তিনি রাজনীতিবিদ। তিনি দেশের ক্রিকেটে রাজনীতি ঢুকিয়েছেন। তিনি ক্রিকেট থেকে দু’জন সংসদ সদস্য বের করেছেন। এ ছাড়া তো আমি তো তাঁর কোনো ভূমিকা দেখি না। রাজনীতি দিয়ে তো আর ক্রিকেট চলে না।
আপনি দেখেন, বিশ্বকাপের সময় আমাদের দুই সিনিয়র ক্রিকেটারের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে গেল। সেখানে বোর্ডও যুক্ত হল। এটা হওয়ার কথা নয়। পঞ্চপাণ্ডব আর কোচের ইস্যুতে আমার মনে হয় বোর্ড দুই রকম করে ভাবে। এখানে স্পষ্টত আচরণের ক্ষেত্রে বোর্ডের একটা বিভাজন আছে। তাঁরা সিনিয়র আর জুনিয়রদের আলাদা ভাবে ট্রিট করে। সেজন্য দলের মধ্যে দুই বা তারও বেশি গ্রুপ হয়ে যায়। এই সমস্যার প্রভাবটা মাঠে দেখা যায়। দিন শেষে আমরা সবাই তো জাতীয় দলের ভাল খেলাটাই দেখতে চাই।
- ফারুক ভাই এখন পরিবর্তনের কথা বলছেন। আমি তাঁর সাবেক সতীর্থ। এক সাথে আপনারা বিশ্বকাপ খেলেছেন। সাবেক সতীর্থ হিসেবে আপনার তাঁর কাছ থেকে চাওয়া কি?
ফারুক ভাই ভাল মানুষ। তিনি ভাল ক্রিকেট বোঝেন। অবশ্যই তাঁর কাছ থেকে পজিটিভ কিছুই আশা করব। কিন্তু, বোর্ডটাও টিম গেম। ক্রিকেটেরই মত। এখানে উইকেটরক্ষককে দিয়ে বোলিং হবে না। আমরা যখন কোচদের ট্রেনিং করাই তখনও সব আলাদা হয়। এখানেও তাই, ফারুক ভাই একা এখানে কিছু করতে পারবেন না। সবাইকে নিয়ে তিনি কি আউটপুট বের করে আনতে পারেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আমার ক্রিকেট বলতে কিন্তু জাতীয় দল নয়। আমাদের জাতীয় দলের বাইরেও ভাবতে হবে। ঢাকার বাইরে অনেক জায়গায় অনেক রকমের অনিয়ম হয়। আমার অনেক জায়গা থেকে অনেক রকম প্রতিভা বের করে আনাও সম্ভব। পরিবর্তনটা আসলে সব ভাবে হওয়াটা জরুরী।