আচ্ছা মিস্টার রাহুল দ্রাবিড়, মনে পড়ে সেই ২০০৫ সালের ২৫ নভেম্বরের ইডেন উদ্যান? চার্ল ল্যাঙভেল্টের বলটা কভার অঞ্চলে রীতিমতো অ-দ্রাবিড়ীয় ঢঙে ঠেলতে গিয়ে যখন নড়িয়ে দিল আপনার অফস্ট্যাম্প, তখন তো রীতিমতো উন্মত্ত গ্যালারি। একে সকলের প্রিয় বাঙালি আইকনের (সাবেক অধিনায়ক ও বটে) দল থেকে অপসারণ তাতে যেন বাড়তি স্ফুলিঙ্গ যোগ করেছে তার জায়গায় আসা নতুন অধিনায়কের ৩১টি বলের সামনে দাঁড়িয়ে মাত্র ৬ করে ফেরা। যখন আপনাকে উদ্দেশ্য করে আসা কটূক্তি তীব্রতায় কাঁপিয়ে তুলেছিল ইডেন থেকে চাঁদনি চক, কি ভাবছিলেন আপনি? অবাক হননি?
হয়তো সামনাসামনি কখনো আপনাকে এই প্রশ্ন করলে আপনি পরিচিত কায়দায় বলবেন ‘আরে ইডেন গ্যালারি তো সুনীল গাভাস্কারকে ছাড়েনি, আমি আর কে?’ হয়তো অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল ছেড়ে দেওয়ার মতোই এড়িয়ে যাবেন কিন্তু তাও তো থেকে যায় প্রশ্ন। নিজের ঘরের মাঠে এতটা অচেনা পরিবেশে আপনার অবাক লাগেনি? হয়তো কিছু ভুল বোঝাবুঝি ছিল আপনাকে নিয়ে, তার ফলস্বরূপ এতটা অপমান কিভাবে সামলেছিলেন?
রাহুল দ্রাবিড় মানুষটা হয়তো এরকমই। যার চারদিকে ঘটে যাওয়া ঘটনা তাকে ভাঙতে পারে হয়তো, কিন্তু মচকাতে পারবেনা। অবশ্য যাকে ‘ওয়াল’ বলা হয় তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বলা যেত চির ধরতে পারে, কিন্তু ভেঙ্গে পড়ায় তিনি নৈব নৈব চ। নাহলে কি আর টানা ৪০ বল ধৈর্য ধরে খেলার পর প্রথম সিঙ্গেল নেওয়ার পর যখন ব্যাঙ্গের হাততালি দিয়েছিল ক্যাঙ্গারু দেশের গ্যালারি তখন কি ব্যাট তুলে সব ব্যাঙ্গ মাথা পেতে নিয়ে করতে পারেন হাফ সেঞ্চুরি? বা ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়ার খবর শুনে হাসিমুখে ‘ওহ, আমি নেই!’ বলে দরজা বন্ধ করে দেন ঘরের?
তিনি বিশ্বাস করতেন যে জীবনে আর কিছু থাকুক আর না থাকুক, সকালের দু’ঘন্টা নেট তাঁর হাতে আছে, ওই সময়টুকু যেন শুধুই নিজের জন্য থাকে। ওই দু’ঘন্টা নেট যেমন জীবনের মাঠের সকল ক্লান্তি মুছে দিতে পারে আবার তাই সাহায্য করে দেশের অন্যতম সবচেয়ে বড়ো ভরসা হয়ে উঠতে।
ভরসার কথা সহ-খেলোয়াড় থেকে বিদেশি খেলোয়াড়রাও বলেছেন বারবার। শচীন টেন্ডুলকার বলেন, ‘০/১ অবস্থায় ব্যাট করতে গেল রাহুল। আমি এটুকু জানতাম যে যখন আমি ব্যাট করতে যাবো স্কোর ০/২ হবেনা, হলেও ও আমার সাথে থাকবে।’
ব্রায়ান চার্লস লারা বলেন, ‘আমি আমার জীবনের পরিবর্তে কাউকে ব্যাট করতে পাঠালে দ্রাবিড় বা কালিসকে পাঠাবো।’
তিনিও সেই ভরসার দাম দিয়েছেন। রেকর্ডবুক দেখলে পাওয়া যাবে সেই প্রমান যা বলে তিন নম্বরে নেমে ৫২ গড়ে তিনি করেছেন দশ হাজারের বেশি রান করেছেন, নামের পাশে আছে আঠাশ সেঞ্চুরি। স্ট্যাটিসটিক্স বলে তিনি টেস্ট কেরিয়ারে ১৬৪ ম্যাচে খেলেছেন ৩১২৫৮টি বল, যা অন্য যে কারোর থেকে বেশী। কিন্তু লোকটাকে দেখুন! প্রশংসা করলে যেন সম্পূর্ণ ভাবে এড়িয়ে গেছেন।
– আচ্ছা রাহুল, সৌরভ গাঙ্গুলীর অধিনায়কত্বে জয়লাভ করা টেস্টে আপনার গড় ১০৪। কিছু বলবেন এই নিয়ে? – ‘ও তাই? হতে পারে।’
এই কথা শুনেছি বারবার। নির্বিকারভাবে যেন ‘আরে এতো কিছুই নয়’ ভাব দেখানো। অবশ্য শুধু প্রশংসা কেন? শচীনের ১৯৪ এর মাথায় ইনিংস ডিক্লেয়ার করা বা গুরু গ্রেগের গুরুকুলে তাঁর ভূমিকা বা হঠাৎ টেস্ট ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে দেওয়া সব নিয়েই তো প্রশ্ন উঠেছে। এক একজন বলেছেন এক এক ভাবে তাদের বিশ্লেষণ দিয়ে। রাহুল থেকেছেন একইরকম চুপ। ঠিক যেমন তিনি থেকেছেন নিজের প্রশংসার সময়ে, ঠিক যেমন থেকেছেন প্রতিপক্ষ স্লেজিং করার সময় তেমনি।
আজও ওই কর্মব্রত লোকটা নিরন্তর খেটে চলেন নিজের দেশের তরুণদের জন্য। তিনি বলেন, ‘আমি ওদের ভারতে তাড়াতাড়ি খেলানোর প্রতিযোগিতায় নামাতে চাই না, আমি ওদের রঞ্জি ট্রফির জন্য অভ্যস্ত করতে চাই তবেই ওরা বেশিদিন ভারতের জন্য খেলতে পারবে।’
খেলোয়াড় জীবনে যেমন বিশ্বাস করতেন সেঞ্চুরির পরের মুহুর্ত যেখানে আপনি নিজে নিজের সঙ্গে দাঁড়িয়ে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্ত, এখানেও যেন তাই। লড়াইটা নিজের সঙ্গে নিজের, বহির্বিশ্বের সাথে পাঙ্গা নয়।