যে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে তিন ধরনের ফলাফল সম্ভব; জয়, পরাজয় এবং ড্র। কিন্তু কখনও শুনেছেন, আম্পায়ার ম্যাচ বাতিল ঘোষণা করে এক পক্ষকে জয়ী ঘোষণা করে দিয়েছে। পাড়ার ক্রিকেটে এমন ঘটনা হর-হামেশাই ঘটে, কিন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিরল এ ঘটনা এক বারই ঘটেছে। হ্যাঁ, এমনটিই ঘটেছিল ২০০৬ সালে ওভাল টেস্টে।
আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার পাকিস্থানের বিরুদ্ধে বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ আনলে মাঠে নামতে অস্বীকৃতি জানায় ইনজামাম উল হকের দল। ফলশ্রুতিতে নাছোড়বান্দা ড্যারেল হেয়ার এবং বিলি ডকট্রোভ ম্যাচ বাতিল ঘোষণা করে ইংল্যান্ডকে জয়ী হিসেবে ঘোষণা করেন। ইতিহাসে সেবারই প্রথমবারের মত টেস্টের অধিকার হারায় কোনো একটি দল। আর সেই দিলটির নাম পাকিস্তান।
ঘটনার সূত্রপাত চতুর্থ দিনের চা বিরতির ঠিক আগে। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ডের হয়ে ব্যাট করছেন কেভিন পিটারসন এবং পল কলিংউড। তখনই আম্পায়ার হেয়ার পাকিস্থানের বিরুদ্ধে বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ আনেন এবং অতিরিক্ত পাঁচ রান জরিমানা করেন। পাশাপাশি দুই ব্যাটসম্যানকে নতুন বল বেছে নেবারও সুযোগ দেন। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু না বললেও চা বিরতিতে ড্রেসিংরুমে গিয়ে ঘটনার প্রতিবাদে আর মাঠে না নামার সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্থান অধিনায়ক ইনজামাম উল হক।
তিনি ব্যাপারটাকে দেশ এবং জাতির জন্য অসম্মানস্বরূপ দেখছিলেন। চা বিরতির পর দুই ব্যাটসম্যান এবং আম্পায়ার মাঠে নেমে আসলেও দেখা মিলছিল না পাকিস্থান দলের। এর মাঝে হেয়ার পাকিস্থান ড্রেসিংরুমে গিয়ে ১৫ মিনিটের মাঝে মাঠে নামতে বলেন। কিন্তু ১৭ মিনিট চলে গেলেও পাকিস্থান মাঠে না নামলে আম্পায়ার হেয়ার এবং ডকট্রোভ মিলে স্ট্যাম্পের বেল ফেলে দিয়ে খেলার সমাপ্তি টানেন এবং ইংল্যান্ডকে জয়ী ঘোষণা করেন। প্রথমবারের মতো ক্রিকেটে কোনো ম্যাচের সমাপ্তি এভাবে ঘটে।
ভাবছেন ঘটনা শেষ? তাহলে ভুল ভাবছেন। নাটকীয়তার তো কেবল শুরু। পাকিস্থান দল জরুরী বৈঠক ডাকে। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) সভাপতি শাহরিয়ার খান, দলের অধিনায়ক ইনজামাম উল হক, ম্যানেজার জহির আব্বাস থেকে শুরু করে মিটিংয়ে উপস্থিত হন ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) চেয়ারম্যান ডেভিড মরগ্যান। মিটিংয়ের পর মাঠে নামতে রাজি হয় পাকিস্থান দল।
ম্যাচ রেফারি মাইক প্রক্টরের কাছে তারা জানায় মাঠে নামতে প্রস্তুত তারা। ৫৫ মিনিট পর যখন পাকিস্থান দল মাঠে নামে তখন বেঁকে বসেন দুই আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার এবং ডকট্রোভ। বারবার অনুরোধের পরও ম্যাচ পরিচালনা করতে রাজি হননি তাঁরা। সন্ধ্যার দিকে দিনের খেলার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
সারারাত দুই দলের ম্যানেজার, বোর্ড সভাপতি এমনকি ম্যাচ রেফারি মাইক প্রক্টরও তাঁকে মাঠে নামতে রাজি করাতে পারেনি। ফলে পরদিন পিসিবি এবং ইসিবির যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, পাকিস্তান ক্রিকেটীয় আইন অমান্য করে মাঠে নামতে অস্বাকৃতি জানানোয় আম্পায়াররা ইংল্যান্ডকে জয়ী ঘোষণা করেছেন। যদিও সে ম্যাচের ফলাফলের আগেই সিরিজ নিজেদের করে নিয়েছিল স্বাগতিকরা।
পুরো বিশ্বেই সমালোচনা-নিন্দার ঝড় তোলে এই ঘটনা। পাকিস্তান অধিনায়ক ইনজামাম উল হককে চার ম্যাচে নিষিদ্ধ করা হয় খেলতে অস্বীকৃতি জানানোতে। যদিও আইসিসির তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। হেয়ারের ক্যারিয়ারেও আসে পরিবর্তন।
সে বছরের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আম্পায়ার লিস্ট থেকেও সরিয়ে নেয়া হয় তাঁর নাম। আইসিসির এক ফাঁস-কৃত মেইল থেকে জানা যায় আম্পায়ারিং থেকে সরে যেতে পাঁচ লক্ষ ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছিল আইসিসি। কিন্তু তাতে অস্বীকৃতি জানান হেয়ার। যদিও এরপর তার আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারও দীর্ঘায়িত হয়নি। বছর খানেক পরই অবসরে চলে যান তিনি।
তবে, ওভালের ঘটনা নিয়ে আদৌ কখনো তিনি অনুতপ্ত ছিলেন না তিনি। কে জানে, অর্জুনা রানাতুঙ্গা হয়তো ঠিকই বলেছিলেন, ‘ড্যারেল হেয়ারের উপমহাদেশীয় দলগুলোর প্রতি এক রকম বিদ্বেষ কাজ করে।’
মাঝে একবার পিসিবি ম্যাচটিকে ড্র এর স্বীকৃতি জানানোর দাবি জানিয়েছিল আইসিসিকে। কিন্তু এমসিসির প্রতিবাদের মুখে তাদের সেই চেষ্টা খুব একটা আলোর মুখ দেখেনি আর। সব মিলিয়ে এই টেস্টটি স্মরণীয় হয়ে আছে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত এক ম্যাচ হিসেবে।